শিক্ষকদের গাইড বই নির্ভরতা

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করুন

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শিক্ষার্থীদের গাইড বই পাঠ নিরুৎসাহিত করতে সরকার গত কয়েক বছর ধরে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মাধ্যমে যখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে তৎপর, তখন জানা গেল শিক্ষকদের গাইড বই নির্ভরশীলতার বিষয়টি। সম্প্রতি এডুকেশন ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শিক্ষকদের নিয়ে এমন উদ্বেগজনক তথ্য। প্রতিবেদন মতে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দেশের মাধ্যমিক স্তরে ৩৭ শতাংশের বেশি শিক্ষক বাজার থেকে কেনা নোট-গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। আরও উদ্বেগের যে, এসব শিক্ষকের ২২ দশমিক ৪ ভাগ নিজের বাসায় অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়ান। প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না বেশির ভাগ শিক্ষক। ১৪ দশমিক ৪ ভাগ শিক্ষক সরাসরি শিক্ষক সমিতি বা খোলাবাজার থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা নেন নিজ স্কুলে। এডুকেশন ওয়াচের এই তথ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে, এমনটি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তথ্য অনুযায়ী, সরকার দেশের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ করে থাকে। আর শিক্ষাব্যবস্থায় এই পদক্ষেপ শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। ফলে শিক্ষকদের এহেন কর্মকান্ড দেশে মানসম্মত শিক্ষার প্রশ্নে নেতিবাচক ধারণারই জন্ম দিয়ে চলেছে। যদিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। প্রতিবেদনে এই বৈষম্য নিরূপণ করা হয়েছে সরকারি, এমপিওভুক্ত এবং নন-এমপিও- এই তিন ধরনের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো বিশ্লেষণ করে। গবেষকরা বলছেন, শিক্ষণ-শিখন মূলত শ্রেণিকক্ষেই হওয়া উচিত। তা সত্ত্বেও শিক্ষকদের গাইড বই ব্যবহার ও প্রীতি এবং গৃহশিক্ষকতায় অংশগ্রহণের প্রবণতা মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে নিঃসন্দেহে। বলাই বাহুল্য, একজন শিক্ষক যখন বাসায় কোচিং করান কিংবা পৃথকভাবে গড়ে ২৩.৩ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান; তখন ওই শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়। এতে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। সঙ্গত কারণে শিক্ষকদের এহেন প্রবণতার অবসানই প্রত্যাশা করেন অভিভাবকরা। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিদ্যালয়ের ১৭.১ শতাংশ, বেসরকারি বিদ্যালয়ের ২৩.৭ শতাংশ, স্কুল ও কলেজ ২৪.২ শতাংশ, দাখিল মাদ্রাসার ১৯.৭ শতাংশ, উচ্চতর মাদ্রাসার ২০.৭ শতাংশ শিক্ষক গৃহশিক্ষকতায় নিয়োজিত। আর এসব শিক্ষকদের মধ্যে গণিতের শিক্ষকরা সবার শীর্ষে, ইংরেজি শিক্ষকরা আছেন এদের ঠিক পরই, তার পর আছেন বিজ্ঞান বিষয়গুলোর শিক্ষকরা। শিক্ষকরা গাইড বই ব্যবহার করেন ৩৭.১ শতাংশ। ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের জন্য মাধ্যমিকের সব শ্রেণিতেই গাইড বই ব্যবহার করেন। নবম ও দশম শ্রেণিতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতের ক্ষেত্রে এবং মাদ্রাসার সব শ্রেণিতে আরবি বিষয়ে গাইড বই ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। আমরা মনে করি, সরকার যেহেতু দেশে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছে, তখন শিক্ষকদেরও এমন নেতিবাচক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার কার্যকর উদ্যোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। পাশাপাশি উলেস্নখ করতে চাই যে, বেতন বৈষম্যের কারণে যদি শিক্ষকরা গৃহশিক্ষকতা এবং গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তা দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের। গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বার্ষিক গড় আয় ৫ লাখ ৩৭ হাজার। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ২ লাখ ৮৬ হাজার। এ ছাড়া এমপিওবিহীন শিক্ষকের ১ লাখ ৪১ হাজার। বলার অপেক্ষা রাখে না, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বেতন বৈষম্য যেমন নিরসন হওয়া আবশ্যক তেমনিভাবে মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে পারে তারও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় এলে, তাদের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে এমনটি প্রত্যাশা করা দোষের নয়। সর্বোপরি বলতে চাই, মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য প্রতিষ্ঠানের ধরনভেদে চাকরি ও অবসরকালীন আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা বিধানের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া শ্রেণি শিক্ষকদের মানোন্নয়নে শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলার নিমিত্তে তাদের পাঠদান দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক মূল্যায়নেরও ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রত্যাশা করব, প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টরা আমলে নিয়ে এমন উদ্যোগ নিশ্চিত করুক যাতে সার্বিকভাবে মানসম্মত শিক্ষার প্রসার ঘটে।