শিক্ষক হেরে গেলে হেরে যায় জাতি

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন মুখ খুলছে। বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। এ নির্যাতনের দায় অবশ্যই ভিসি, প্রক্টরদের নিতে হবে।

প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
পান্ডবদের সঙ্গে অন্যায় দেখেও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন গুরু দ্রোনাচার্য। নিজের সন্তানের কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ থেকেও সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় প্রতিবাদ করতে পারেননি অন্যায়ের। ধু্রপদীর অসম্মানে মাথা নিচু করে মৌনব্রত পালন করেছে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। পরিণতি ভয়াবহ কুরুক্ষেত্র। সে সব অপরাধের জন্য যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তা নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, বাংলাদেশে এসব অপরাধের প্রত্যেকটি ঘটছে। 'সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়। মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।' হাদিস মিথ্যের মধ্যে ডুবন্ত আমরা ধ্বংসের অপেক্ষায় আছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষায় বিপস্নব ঘটানোর জন্য আর যুব সমাজের প্রতি অবদানের জন্য যখন পুরস্কৃত হন তখন তারই দলের ছাত্ররা পিটিয়ে মেরে ফেলে ছাত্রকে। চারিদিকে সৃশংস এত মৃতু্য- যা আমাদের অনুভূতিকে ভোতা করে দিচ্ছে। একটার চাপ শেষ হতে না হতে অন্যটি আরো ভয়াবহ হয়ে সামনে আসছে। কত প্রতিবাদ করব আমরা? শিক্ষার মূল উপাদান দুটি। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী। উন্নত দেশ, উন্নত সভ্যতা ধীরে ধীরে শিক্ষা কার্যক্রমের ফলপ্রসূ এবং উন্নত করতে এই দুই উপাদানের সঙ্গে অনেক কিছু যোগ করেছে। আমাদের ডিজিটাল ক্লাস রুম, দৃষ্টিনন্দন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আধুনিক, প্রযুক্তিগত উপকরণ সব দিক দিয়ে চোখ ধাঁধানো উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু শিক্ষা দেবেন যিনি, প্রতিষ্ঠানের প্রধান তার সে ক্ষেত্রে অবনতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই আজ আবরারের ভয়াবহ মৃতু্য সারা দেশবাসীকে কাঁদাচ্ছে, ভাবাচ্ছে। কার আমলে কয়টা মৃতু্য ঘটেছে সেই হিসাবে খাতা খুলে রাজনৈতিক দলগুলো যখন বসেছে নির্লজ্জের মতো ব্যাখ্যা দিতে আমরা তখন টিভি সেটের সামনে বসে দেখি আমাদের সন্তানদের নৃশংস মৃতু্য, আমাদের সন্তানদের মানুষ থেকে জানোয়ারে পরিণত হওয়া। ২০১০ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি দিবাগত রাতে স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হন আবু বকর সিদ্দিক। ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। চতুর্থ সেমিস্টারে ফল বের হলে দেখা যায় সিজিপি ৪-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৭৫ পায় আবু বকর। কিন্তু তার আগেই সে চলে যায় না ফেরার দেশে। দিন মজুর রুস্ম আলী আর মা রাবেয়া খাতুনের ছেলে আবু বকরকে যারা হত্যা করেছিল তারা কখন বেকসুর খালাস পায় তা কেউ জানে না। যখন জানল তখন আপিল করার সময় শেষ। আবু বকরের মা সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিল, 'এইডা ক্যামন দ্যাশ? আমার বাবারে যারা মারল তাগো কোনো বিচার হইলো না?' বিশ্বজিৎকেও যারা কুপিয়ে ছিল তারাও ছাত্রলীগ। চ্যানেল ঘুরাইল সেই ছবি। তারপরও তারা ছাড়া পেয়ে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, অপরাধীরা ছাড় পাবে না। ফাঁসির আসামি রাজন তালুকদার দার্জিলিং থাকে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কামরুল হাসান পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সিন্ডিকেট চালাচ্ছে। অনেকেই বেকসুর খালাস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছে। এর মধ্যে ২ জন ছাত্রলীগ, ৩ জন শিবির নেতা ছিলেন। তিনজন ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হন ৫ শিক্ষার্থী। উচ্চ বিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত প্রতিটি পরিবারের মেধাবী সন্তানের লাখ লাখ প্রতিযোগীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মা-বাবার অনেকগুলো বছরের শ্রম, ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্নের দায়িত্ব নিয়ে এসব পরিবারের সন্তানরা পড়তে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তাদের নানা মত, নানা দল থাকতেই পারে। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়াই স্বাভাবিক। একজন পিতার সব সন্তান চিন্তায়, কর্মে যেমন সমান হয় না। তেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাদের ভাবনায়, কর্মে এক হবে না এটাই সত্য। পিতা তার স্নেহ, শাসন, ভালোবাসা দক্ষতা দিয়ে তার সন্তানকে যেমন পরিচালিত করেন তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করা, তাদের সমস্যার কথা গুরুত্বসহ শোনার দায়িত্ব ভিসির। প্রশ্ন হলো এই যে এত খুন, নির্যাতন, টর্চার সেল এগুলোর দায় কি শুধুই ছাত্রদের? প্রথম দায় কি অভিভাবক হিসেবে ভিসির নয়? হুমায়ূন আহমেদ তার ছাত্রজীবনের স্মৃতি উলেস্নখ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন তার লেখায়। তিনি লিখেছেন, হলের একটি রুম থেকে নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেতেন প্রায় রাতেই। খবর নিয়ে জানলেন, ওই রুমে একটি মেয়েকে নেতারা আটকে রেখে প্রতিদিন রাতে নির্যাতন করে। ঘটনা জানার পর তিনি ছুটে যাচ্ছিলেন প্রক্টরের কাছে। কিন্তু অন্যরা জানাল প্রক্টর সবই জানে। অবশেষে অসহায়, মর্মাহত হয়ে একাকী বসে রইলেন রুমে। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, সেদিনও শিক্ষকের মেরুদন্ড ছিল না, আজও নেই। সুতরাং আমাদের আমল ধোয়া তুলসীপাতা ছিল। আমাদের সময় শিক্ষকরা মেরুদন্ড সোজা করে চলতে পারতেন এটা বলার অবকাশ নেই। আমরা ধীরে ধীরে শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়েছি অনেকটা পথ। তাহলে মানবিকতায় কেন এগিয়ে যাব না? মেধায় বড় হব, মননে কেন নয়? যে মেধার সঙ্গে মানবিকতার সম্পর্ক থাকে না সে মেধা কতটা ভয়ঙ্কর রূপে দেখা দেয় তা আবরারের মৃতু্যই তার প্রমাণ। একজন আবরারের মৃতু্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বহু ভয়ঙ্কর তথ্য। টর্চার সেল নামক মধ্যযুগীয় প্রথা দেশের নানা জায়গায় কেন আছে তা নিয়ে না হয় আমরা মাথা না ঘামালাম। কিন্তু টর্চার সেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন আছে তার জবাব শিক্ষক এবং ভিসিকে তো দিতেই হবে। মেধাবী সন্তানগুলো মা-বাবা মানুষ হিসেবে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোন সে অলৌকিক ক্ষমতা যার প্রভাবে এই মানুষগুলো লীগ, দল, শিবিরে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেখানে সাদা, নীলে বিভক্ত হয়ে যখন যে ক্ষমতায় থাকে তারই আনুগত্য স্বীকার করে নেয়, তখন শিক্ষার্থীদের হঠাৎ পাওয়া সীমাহীন ক্ষমতা আর অর্থে তাদের বিভ্রান্ত করাই স্বাভাবিক। শিক্ষক যদি শাসন করার ক্ষমতা হারিয়ে নিজে শাসিত হয় তা হলে হিংস্রতার বিস্তার ঘটে। একজন শিক্ষার্থীর মৃতু্য যদি ভিসির কাছে তার সন্তানের মৃতু্য মনে না হয় তাহলে সে ভিসি পদে থাকার যোগ্য নয়। শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। ফেরাউনের আমলে ১০০ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ১০০ বছরের অন্ধকার প্রজন্ম পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছিল আনুগত্যশীল হিসেবে। রাজার কথাই ছিল শেষ কথা, রাজাই ছিল ঈশ্বর। আধুনিক সভ্য যুগে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে নয়। প্রতিষ্ঠানে মেরুদন্ডহীন, অনুগত প্রধান নিয়োগ করে পরোক্ষভাবে শিক্ষা ধ্বংস করে, লোভ আর ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের পোষা প্রাণী তৈরি করে বাইরে শিক্ষা আর ভেতরে মানবিকতা আঁধারে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। আবরারের জন্য কাঁদছে সারাদেশ। এই কান্না ছড়িয়ে গেছে দেশ থেকে অন্য দেশে। কিন্তু আমরা কি ভাবব না খুনিদের কথা? তাদের মা-বাবা লজ্জায় অপমানে কাঁদছে মুখ লুকিয়ে। তিল তিল করে গড়ে তোলা একটি সুন্দর স্বপ্ন এক নিমিষে ধূলায় মিশিয়ে দিল যে সন্তানের অপকর্ম; আমরা কি সে মা-বাবাদের কষ্ট উপলব্ধি করছি? যারা লাখ লাখ টাকায় পর্দা, বালিশ আর চেয়ার কেনেন, যারা জুয়ার আড্ডা পরিচালনা করেন, এই খুনিরা কী তাদের সন্তান নয়। এ দেশের খেটে খাওয়া, রক্ত জল করা অতি সাধারণ মা-বাবার সন্তান এরা। এদের মেধায় মা-বাবা গর্ব করতেন। এদের পরীক্ষার ভালো ফলাফলের প্রতিটি ধাপে মা-বাবার স্বপ্নের জাল বুনেছেন সোনালি দিনের। অথচ এরা মানুষ না হয়ে হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হলো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে গিয়ে। ভিসি, প্রক্টর কি জানেন না, একাই একরুম দখল করে থাকার কথা; মদের আড্ডার কথা, নির্মম নির্যাতনের কথা। তাহলে এদের কাজ কী? কী কাজ করে এরা মাসে মাসে বেতন নেন? শিবির কি নিষিদ্ধ দল? যদি না হয় তা হলে শিবির তকমা লাগিয়ে ছাত্রদের নির্যাতনের অধিকার কে দিল ছাত্রলীগকে? এক সময় শিবির চিহ্নিত ছিল 'রগকাটা' দল হিসেবে। শিবির ছিল গালি। কিন্তু বর্তমান চিত্র কী বলে? ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি,র্ যাগ, খুন- যেদিকে যত অপকর্ম সবকিছুতেই ছাত্রলীগের নাম। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন মুখ খুলছে। বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। এ নির্যাতনের দায় অবশ্যই ভিসি, প্রক্টরদের নিতে হবে। মেরুদন্ড সোজা করে, নিরপেক্ষতা, সততা নিয়ে শিক্ষকসুলভ আচরণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষাদানের ক্ষমতা যদি এদের না থাকে তাহলে কোন যোগ্যতায় এই পদ তারা দখল করে রাখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেন সাদা, নীল দল থাকবে? তারা কেন রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকবেন? একটা জাতিকে পথ দেখাবেন শিক্ষক। সে শিক্ষক যদি হেরে যান তাহলে পুরো জাতিই হেরে যায়- এ সত্য আমরা কি বুঝতে পারছি? শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক