জাতির পিতার আদর্শে বেড়ে উঠুক প্রতিটি শিশু

প্রত্যেক শিশুকে জাতির পিতার আদর্শে জীবন গড়ার ও তারই মতো মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আত্মনিয়োগ করতে হবে পিতামাতা ও শিক্ষকদেরই। তাহলে আমরা পাব একটি সুন্দর দেশ ও উন্নত জাতি। যে দেশ ও জাতি আগামী দিনে জাতির পিতার দেখানো পথেই বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সাধন সরকার
প্রতিবছর জাতির পিতার জন্মদিনের (১৭ মার্চ) সঙ্গে 'জাতীয় শিশু দিবস'ও পালন করা হয়। প্রতিটি শিশুর প্রতি বঙ্গবন্ধুর আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল। প্রতিটি শিশুকে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল। শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, জাতির পিতার মানবীয় গুণাবলির চর্চা ও আদর্শ শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া, শিশুদের প্রতি জাতির পিতার ভালোবাসা স্মরণের জন্যই মূলত জাতির পিতার জন্মদিনের সঙ্গে জাতীয় শিশু দিবস পালন করার অন্যতম উদ্দেশ্য। উলেস্নখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৭ সালে জাতির পিতার জন্মদিনটির সঙ্গে জাতীয় শিশু দিবস একসঙ্গে পালিত হয়ে এলেও ২০০১ সাল থেকে কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আবার ২০০৯ সাল থেকে নিয়মিতভাবে দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। জাতির পিতা বিশ্বাস করতেন, এই শিশুদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ। সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি শিশুদেরও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। এরই পথ ধরে ১৯৭৪ সালে জাতীয় শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। তিনি শিশুদের প্রতি অবারিত দুয়ার খুলে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শিশুকাল থেকেই ছিলেন অন্যায় ও সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বাংলার নদী-মাটি-কাদাজল মাড়িয়ে বেড়ে ওঠা এই দেশপ্রেমিক মানুষটি সর্বদা দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভেবেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তার আপসহীন ভালোবাসার কারণেই আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বৈষম্যের প্রতি সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন গরিব-দুঃখী মানুষের আপনজন। জাতির পিতা সব ধরনের মানবীয় গুণাবলি ও ভালো কাজের চর্চা ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে রপ্ত করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালির জেগে উঠবার প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সামনের কাতারে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু একই সূত্রেগাথা। তারই দেখানো পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, এগিয়ে নিতে হবে শিশুদের। শিশুদের জন্য কিছু করার আগ্রহ তিনি প্রবলভাবে অনুভব করতেন। যখনই সময় পেতেন তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, তিনি যখন কোনো কাজে গ্রামেগঞ্জে যেতেন, কোনো সভা-সমাবেশে যেতেন শিশুদের দেখলেই তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন, গল্প করতেন খোঁজখবর নিতেন। এমনকি গণভবনেও তিনি শিশুদের সময় দিতেন, বিশেষ দিনগুলো শিশুদের মাঝে কাটাতেন। শিশুরাও জাতির পিতাকে আপন করে নিত। জাতির পিতার বহু মানবীয় গুণের ঘটনা আমাদের জানা। যেমন: ছোটবেলায় বর্ষাকালে নিজের বাবার কিনে দেয়া একমাত্র ছাতাটা তিনি এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া শীতকালে এক বৃদ্ধাকে নিজের চাদর দিয়ে আসার গল্পও আমাদের জানা। মানুষকে তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন। প্রতিটি শিশু হাসিখুশির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠুক এটা তিনি সবসময় চাইতেন। শিশুরা মুক্তমনা, সৃজনশীল, দেশপ্রমিক হয়ে বেড়ে উঠুক- এটাই তিনি ভাবতেন। জাতির পিতার জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন যেতেন তখন তিনি তাদের গাছপালা নষ্ট না করার কথা, পরিবেশ রক্ষার কথা, খেলাধুলার কথা বলতেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছোট-বড় সবার অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, মানুষকে আজীবন ভালোবেসে গেছেন। এ কারণেই তিনি সহজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ও অধিকার আদায়ে শামিল করতে পেরেছেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তিনি দেশে-বিদেশে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। তারই দেখানো পথে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে হবে, ভালোবাসতে হবে। তাহলে তারাও ভালোবেসে এ দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিশু-কিশোরদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, 'শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুদের মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।' (বিশেষ ক্রোড়পত্র, তথ্য মন্ত্রণালয়- ১৭ মার্চ, ২০১৯)। জাতির পিতা শৈশব-কৈশোর থেকেই হেসেখেলে, বাঁধনহারা আনন্দে, মুক্ত বাতাসে, মুক্তমনে বেড়ে উঠেছেন। আমাদের শিশুরা যাতে এ ধরনের পরিবেশ পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই। শিশু-কিশোরদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে। মা-বাবা ও শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের যেন বন্ধুত্বসুলভ আচরণ হয়, এটা গুরুত্বের সহিত ভাবতে হবে। তাহলে তাদের আর বিপথে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা থেকে জানা যায়- 'আমার দাদা-দাদি ছেলের (বঙ্গবন্ধুর) কোনো কাজে কখনো বাধা দিতেন না; বরং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার বাবার মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ যখনই যেটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে, আমার দাদা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন' (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র, ১৯৯১)। বর্তমান সরকারও শিশু-কিশোরদের সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন কল্যাণমুখী উদ্যোগ ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। শিশুর অধিকার ও তাদের নিরাপত্তায় প্রতিবছর 'বিশ্ব শিশু দিবস' ও 'শিশু অধিকার সপ্তাহ' পালন করা হচ্ছে। জাতীয় শিশু নীতি-২০১১, শিশু আইন-২০১৩ পাসসহ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, পথশিশুদের পুনর্বাসন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শিশুদের পিঠে বইয়ের বোঝা এখন কমানো হয়েছে। দেশে এখন শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এসব শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করা, আত্মবিশ্বাস তৈরি করা, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো, খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করা আমাদেরই দায়িত্ব। প্রতিটি স্কুলে এখন বঙ্গবন্ধু কর্নার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধু কর্নার গড়ে তোলার ফলে শিশুরা পড়ালেখার পাশাপাশি সঠিক পথের দীক্ষা পাবে। আজকের শিশু আগামী দিনের পরিণত মানুষ ও দেশ গড়ার কারিগর। প্রত্যেক শিশুর জীবন নিরাপদ, সৃজনশীল, সুস্থ, সুন্দর ও সমৃদ্ধ হোক- এ প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধুর। জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত সোনার বাংলা এই শিশুরাই গড়বে। যন্ত্র নিয়ে কোমলমতি শিশুরা যেন ব্যস্ত না হয়ে পড়ে এ ব্যাপারে মা-বাবা, শিক্ষক ও প্রত্যেক সচেতন মানুষকে নজর দিতে হবে। প্রত্যেক বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত শিশুদের আরও বেশি সময় দেয়া। শিশুরা যত বেশি বড়দের স্নেহ-ভালোবাসা পাবে, বড়দের সান্নিধ্যে থাকবে তত সুস্থ ও নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠবে। জাতির পিতা শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের আঁকা ছবির প্রশংসা করতেন মন খুলে, বাহাবা দিতেন। তাই মা-বাবা ও শিক্ষকদেরও উচিত শিশুদের আরও বেশি প্রশংসা করা। প্রত্যেক শিশুকে জাতির পিতার আদর্শে জীবন গড়ার ও তারই মতো মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আত্মনিয়োগ করতে হবে পিতামাতা ও শিক্ষকদেরই। তাহলে আমরা পাব একটি সুন্দর দেশ ও উন্নত জাতি। যে দেশ ও জাতি আগামী দিনে জাতির পিতার দেখানো পথেই বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সাধন সরকার: কলাম লেখক ও পরিবেশ কর্মী