সংগঠন দায়িত্ব এড়ালে দুষ্কৃতকারীরা প্রশ্রয় পায়

সংগঠনের শৃঙ্খলাকে মজবুত করে ঐতিহ্যবাহী ও বিশাল এই ছাত্রলীগকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেতৃত্বের। আর নেতৃত্বকে সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে, যাতে করে ভিন্ন মতাবলম্বী কেউ প্রবেশ করতে না পারে। তাই বলছিলাম, সংগঠন যদি কোনো অঘটনের দায় এড়িয়ে যেতে চায়, তাহলে কিন্তু 'অনুপ্রবেশকারী' দুষ্কৃৃতরাই প্রশ্রয় পেয়ে যাবে।

প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

কামাল লোহানী
আবরার ফাহাদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঢাকা ফিরে কুষ্টিয়ায় মাকে জানিয়েছিল, সে নিরাপদেই পৌঁছেছে। এ সন্ধ্যেবেলার কথোপকথন। কিন্তু বর্বরতার হিংস্রতা তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে 'টর্চার সেল' নামে পরিচিত ২০১১ নম্বর কামরায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে খুনের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন শিক্ষার্থী যারা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার নানা পদে অধিষ্ঠিত। তাদের নাকি জিজ্ঞাসা ছিল, সে শিবির করে কি না। আবরার যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে ততই ছাত্রলীগ নেতারা তাকে পেটানো ক্রমশ বাড়িয়ে দিয়েছে। পেটাতে পেটাতে এক কামরা থেকে আরেক কামরায় নিয়ে গেছে এবং সে যে শিবির করে, সে কথাটি জবরদস্তি তার মুখ থেকে বের করার চেষ্টা করেছে। পারেনি। মারপিটের বহর ক্রমশ বেড়েছে। দু'জন ডেকে নিয়ে গেলেও বেদম পেটানোতে অংশ নিয়েছে অনেকজন। অবশেষে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নের জবাব না পেয়ে প্রচন্ড প্রহারে ক্ষত-বিক্ষত অবসন্ন দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার পর, কি করবে এই লাশ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা সে ভাবনায় দৌড়াদৌড়ি করছিল। অবশেষে তাকে সিঁড়ির কাছে ফেলে রেখেছিল। শোনা যায়, প্রহারে প্রহারে অজ্ঞান হয়ে গেলে, কী বীভৎস ভাবতে অবাক লাগে, ওই ছাত্রলীগ নেতারা আবরারকে কক্ষে ফেলে রেখে মাঝরাতে খাবারও খেতে গিয়েছিল এবং ফিরে এসে তাদের 'কাজ' সম্পন্ন করে আবরারকে সিঁড়িতে ফেলে রাখে। আবরার মেধাবী ছাত্র ছিল। সে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল। সে পোস্টের সঙ্গে ছাত্রলীগ বা ক্ষমতাসীনদের মতের মিল ছিল না। সে জন্য 'বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক'রা সহ্য করতে না পেরে তাকে জানেই মেরে ফেলেছে। কী আশ্চর্য, কী বীভৎস এ ঘটনা! প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিতে ইতিপূর্বে সম্পৃক্ত ছিল না। বেশ কিছুদিন আগে সনি হত্যা আর এবারে আবরার হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি। কিন্তু কি আশ্চর্য, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির জন্য ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৭২ জনকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অপসারণ করেছেন। এ এক অসাধারণ সিদ্ধান্ত। শুধু কি তাই, তারও আগে এক সময় ছাত্রলীগের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি 'সাংগঠনিক উপদেষ্টা'র দায়িত্বও ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগ সংগঠনের মধ্যে এর কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। না হলে বুয়েটে আবরার হত্যা হবে কেন। এদিকে এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্রদের বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা ১০ দিন ধরে উত্তাল ক্যাম্পাসে উপাচার্য, শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রকল্যাণে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অপসারণসহ ১০ দাবির ভিত্তিতে দিনভর জমায়েত করেছে এবং আবরার ফাহাদের হত্যার বিচার, খুনিদের সবাইকে গ্রেপ্তার, আবরারের পরিবারের প্রতি আর্থিক সহযোগিতা প্রদান ইত্যাদিসহ ৯ দফা দাবিতে সোচ্চার হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। \হপ্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যও আছেন। নাম তার অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। কী আশ্চর্য! বীভৎস বর্বরতার শিকারে পরিণত হয়ে তারই এক ছাত্র প্রাণ দিল কিন্তু ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে তিনি এলেন না, এমনকি হত্যার শিকার আবরার ফাহাদের জানাজায়ও উপস্থিত হলেন না। হায়রে নির্মম পিতা, সন্তানের মৃতু্যতেও মনে তার কোনো শোক সৃষ্টি হলো না। ছাত্ররা প্রথমদিন নিরবচ্ছিন্ন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপাচার্যের উপস্থিতি দাবি করছিল, তাই তিনি ছাত্রদের সামনে না এসে কিংবা আবরার ফাহাদের হত্যার খবর শুনেও অনুপস্থিত থেকে, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। অবশেষে সেই উপাচার্য আন্দোলনকারীদের সামনে উপস্থিত হতে বাধ্য হোন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত উপাচার্য সাইফুল ইসলাম নানা অজুহাত দেখিয়ে তার অনুপস্থিতিকে জায়েজ প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না। তারা ১০ দফার দাবি তাকে জানিয়ে আবরারের হত্যার বিচার, পরিবারকে সহযোগিতা, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ, প্রাধ্যক্ষের অপসারণ ও উপাচার্যের পদত্যাগ ইত্যাদি দাবিতে সোচ্চার ছিল। সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগ নেতাদের মতো অসহিষ্ণু হয়নি, তারা উপাচার্য সাইফুল ইসলামকে রাত সাড়ে ৯টায় অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়। এদিকে আবরার ফাহাদের হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা তো বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলই, তার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও যুক্ত হলেন, সংহতি প্রকাশ করলেন ছাত্রদের সঙ্গে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এ নির্মম হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের দাবিও জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তারা বলেছে, 'ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ কখনো এ ধরনের নৃশংসতায় অংশগ্রহণ করতে পারে না'। আমি এ তরুণ বন্ধুদের বলতে চাই, ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল অতীত পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসই মনে করিয়ে দেয়। মহান ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা অবিস্মরণীয়। পরবর্তীকালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা, ছাত্রদের ১১ দফা এবং '৬৯-র গণ-অভু্যত্থান, '৭০-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, সর্বোপরি '৭১-র মুক্তিযুদ্ধ সাক্ষ্য দেয় ছাত্রলীগের গর্বিত অতীতের। কিন্তু বন্ধুরা, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ছাত্রলীগ সেই ঐতিহ্যকে ধরে এগিয়ে চলতে গিয়েও কেন বিভিন্ন সময় হোঁচট খেয়েছে। আর ঐতিহ্যের পাশাপাশি আদর্শকে জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে ক্ষমতার দাপট যখন জড়িত হয়েছে, তখনই তো এমন কিছু কিছু ঘটনা সময়ে সময়ে ছাত্রলীগ কেন জন্ম দিয়েছে, এ প্রশ্ন আজ কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মনেও। অতীতে ক্ষমতাসীন বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকেও দেখেছি, তারাও নতুন করে ছাত্র সংগঠন দাঁড় করিয়ে অন্যদের ঠাঙানোর কাজ তাদের দিয়ে করিয়েছে। সেই কুৎসিত এবং অবাঞ্চিত ঘটনাপঞ্জির কথা শিক্ষার্থীরা যেমন, তেমনি দেশবাসী/জনগণও তা ভুলতে পারেনি। তাই বলছিলাম, ঐতিহ্য যে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, সে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, তার তো আচরণ গণতান্ত্রিক ও উদার হওয়া উচিত। নিজের দুর্ব্যবহারের সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীলদের জায়গা করে দেয়া উচিত নয়, ওরা তো সুযোগ গ্রহণের জন্যই ওঁৎ পেতে থাকে। ওরা তো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ভাড়াটে এবং ঠাঙানো বাহিনী। বিরোধীদল বলতে যদি বিএনপিকে ভাবি, তাহলে তাদের সৃষ্ট ছাত্রদল ক্ষমতার প্রতাপে জিয়া এবং খালেদার আমলে যেসব কুকর্ম করেছে, তার কথা তো বাংলার মানুষরা ভুলেনি। এটাতো ঠিক সংগঠনের পদধারী যদি কেউ কুৎসিত কিংবা ভয়ঙ্কর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকে তাহলে সেই সংগঠনের ওপরই গিয়ে সবার ক্ষোভটা পড়ে, এড়ানো যায় না। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে। কেন্দ্রীয় নেতারা বলছে, ব্যক্তি অপরাধ করলে সংগঠনকে জড়িত করা উচিত নয়। কথাটা যদি মেনেও নিই তাহলে প্রশ্ন ওঠে পদধারী এতজন যখন এ হত্যাকান্ডে জড়িত তখন কি করে সংগঠনের দায়িত্ব এড়ানো সম্ভব। অতীতে কখনও কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন ঘটলে, সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনের নেতারা তা স্বীকার করে তীব্র নিন্দা করেছেন এবং সেইসঙ্গে দায় অস্বীকার করেননি। তাই আমার ধারণা, একজনও যদি এ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তা মেনে নিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ও নীতি-নৈতিকতার বিচারেই তার শাস্তি হওয়া উচিত, এড়িয়ে যাওয়া নয়। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও, তার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, সব ব্যাপারে দলের সাধারণ কিংবা প্রচার সম্পাদকের অথবা কোনো মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত নয়। ছাত্ররা যেখানে জড়িত সেখানে ছাত্রলীগ নেতারাই এর জবাব দেবে, অন্য কারো উপযাচক হয়ে কথা বলা উচিত নয়। আর তরুণ বন্ধুদের বলব, ঘটনা যদি সত্যি হয়, আর সংগঠনের ভেতরে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি যদি থাকেও তবে 'ছদ্মবেশী অপশক্তি' প্রশ্রয় পাবে। ছাত্রলীগের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, নিজেদের সংগঠনের বাইরে বহু রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন রয়েছে, তারা সবাই যে তোমাদের সঙ্গে একমত হয়ে কথা বলবে, তাই বা ভাবছ কেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যদি মানতেই চাও, তাহলে কিন্তু অন্যের মতকে মেনে নেয়া বা তার প্রতি সহনশীল হওয়া অতীব প্রয়োজন। মতের মিল হলো না বলে তাকে শিবির তকমা লাগিয়ে হত্যা করাটা কি গণতান্ত্রিক? আপনারা এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই 'অনুপ্রবেশকারী'র অপকর্ম বলে নিজেদের দায় এড়াতে চান, এটা ঠিক নয়। মনে রাখবেন আপনারা কিন্তু নিজেরা নিজেদেরকেই ফাঁকি দিচ্ছেন। আর এতে করে সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্নই হচ্ছে। আমাদের সবার ধারণা, ছাত্রলীগ তো কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনমানসিকতার সংগঠন, সেখানে 'অনুপ্রবেশ' করার সুযোগটা পায় কি করে? তবে কি আপনাদের মধ্যেই কেউ কেউ এ জন্য দায়ী নয়? সুতরাং, সংগঠনের শৃঙ্খলাকে মজবুত করে ঐতিহ্যবাহী ও বিশাল এই ছাত্রলীগকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেতৃত্বের। আর নেতৃত্বকে সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে, যাতে করে ভিন্ন মতাবলম্বী কেউ প্রবেশ করতে না পারে। তাই বলছিলাম, সংগঠন যদি কোনো অঘটনের দায় এড়িয়ে যেতে চায়, তাহলে কিন্তু 'অনুপ্রবেশকারী' দুষ্কৃৃতরাই প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। কামাল লোহানী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক