প্রসঙ্গ: শিশু নির্যাতন

প্রকাশ | ২০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

মাহমুদ আহমদ ঢাকা
শিশু নির্যাতন এবং নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের খবর পত্রপত্রিকার বেশির ভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে। অতিসম্প্রতি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে রাতের আঁধারে পাঁচ বছরের শিশু তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ঘুমন্ত শিশুটিকে হত্যার সময় সে বাবার কোলেই ছিল। তুহিনের বাবা আবদুল বাছির ও চাচা নাসির উদ্দিন শিশুটিকে প্রথম ছুরি দিয়ে আঘাত করে। জবাইয়ের পর সবাই মিলে তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। কান কাটে, গোপনাঙ্গ কাটে তারপর রশি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই পাঁচ বছরের শিশু তুহিন হাসানকে নির্মমভাবে খুন করে। খুনের এই লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ শুনলে গা শিউরে ওঠে। ভাবতেই পারছি না যে, কোনো পিতা এতটাও নিষ্ঠুর হতে পারে। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশে বেশ কয়েকটি শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মাস কয়েক আগে ঢাকায় দুই বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, দুই শিশুকে লিপস্টিকের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা ও পরে হত্যা, অন্যদিকে সাতক্ষীরায় তৃতীয় শ্রেণির একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের পর পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে হত্যা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বছর কয়েক আগে পত্র-পত্রিকায় আর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবলে ৪ নিষ্পাপ শিশুদের মরদেহ বালুর নিচ থেকে উঠানোর দৃশ্যও ছিল অসহনীয়। হায় মানুষ! তুই কত নিষ্ঠুর, পাষন্ড। পিতার কোল থেকে নিয়ে মাতৃগর্ভেও আজ শিশু নিরাপদ নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের সন্তানরা কতটুকু নিরাপদ তাও আজ আমাদের ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও আজ নজিরবিহীন, নির্লজ্জ ঘটনা ঘটে চলেছে যা শুনলে হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। আলস্নাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়ে এমন নিকৃষ্ট কাজ করা কীভাবে সম্ভব? সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের এক হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশে ৫৩৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এদের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫ জন শিশুকে। এ সময়ের মধ্যে ৮২ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের শিশু সুরক্ষাবিষয়ক পরিচালক আবদুলস্নাহ আল মামুন বলেছেন, নির্যাতনের এই হার ২০১৭ এবং ২০১৮-র তুলনায় অনেক বেড়েছে। 'বিগত বছরগুলোর তুলনায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। হত্যার ঘটনাও বেড়েছে। তবে আগের চেয়ে তফাৎ হচ্ছে, আগে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার বেশি হতো মেয়েশিশুরা, এখন ছেলেশিশুরাও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।' অন্যদিকে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্র বলাৎকারের ঘটনা যেন পালস্না দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি- জুলাই ১৪, জামালপুরের মাদারগঞ্জে মুসতানির ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি নামে এক মাদ্রাসায় বলাৎকারের শিকার হয়েছে অন্তত ৬ শিশু শিক্ষার্থী। জুলাই ১৩, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের শিক্ষক আরিফুল হাসানকে (৪৬) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জুলাই ১২, এবার মসজিদের ইমামের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে মসজিদের ভেতরে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ডেইল পাড়ায় ঘটেছে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা। জুলাই ১১, ফেনীর ছাগলনাইয়ায় এক মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ উঠেছে। জুলাই ১০, নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে তৃতীয় শ্রেণির এক মাদ্রাসার ছাত্রীকে রুমে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় মাদ্রাসার শিক্ষক। জুলাই ৬, বরগুনায় শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক ও সুপারকে আটক করেছে পুলিশ। মাগুরায় মোহাম্মদ হাবিবুলস্নাহ (১৪) নামের এক মাদ্রাসাছাত্রকে মসজিদের ভেতর ঘুমের মধ্যেই জবাই করে হত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। ১ জুলাই সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সদর উপজেলার চন্ডালখিল এলাকার একটি পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এমন ঘটনা তুলতে গেলে কয়েক পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না বরং এমন ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি শিশুদের প্রতি স্নেহ ভালোবাসার বিষয়ে ইসলামে অত্যন্ত তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। শিশুদের প্রতি যেন কোনোভাবেই কঠোরতা প্রদর্শন করা না হয় এবং দারিদ্র্যের ভয়ে তাদের যেন হত্যা করা না হয়, সে বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, 'আর দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমিই তাদের এবং তোমাদেরও রিজিক দিই। তাদের হত্যা করা নিশ্চয় মহাপাপ' (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩১)। এ আয়াতে শিশুদের হত্যার বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। শিশুদের যদি সঠিক শিক্ষা এবং উপযুক্ত সুবিধার মাধ্যমে তাদের পূর্ণ মানসিক ও নৈতিক বৃদ্ধিপ্রাপ্তিতে সাহায্য করা হয়, তাহলে তারা সমাজের সত্যিকার উপযোগী ও কার্যকর সদস্যে পরিণত হবে। সমাজে আজ শিশুর প্রতি নৃশংসতা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলে আজকাল সচেতন মহলে শিশুহত্যা প্রতিরোধের আহ্বান জোরদার হচ্ছে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশ বছর আগেই শিশু হত্যাকে বারণ করেছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধক্ষেত্রেও কোনো শিশুকে হত্যা করতে বারণ করেছেন। রণাঙ্গনে ভুলক্রমে কোনো ইহুদি শিশু মারা গেলে হুজুর পাক (সা.) সাহাবিদের প্রতি অনেক অসন্তুষ্ট হন। কারণ শিশুরা নিষ্পাপ, মাসুম। তাদের কোনো গোনাহ নেই। অথচ আজ সেই পবিত্র ও মানবদরদি রসুলের উম্মত হওয়ার দাবি করে মানুষ এমন ঘৃণ্য ও অমানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে, যা বিশ্ব মানবতাকেই ক্ষত-বিক্ষত করছে। আমরা জানি, এ বিশ্বের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ পরম দয়ালু আলস্নাহ্‌তায়ালা মহানবী (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে কীভাবে সম্মান করতে হয় তা তিনি শিখিয়েছেন এবং সমাজে শিশু ও নারীদের স্থান কোন পর্যায়ে, তাও তিনি নিজ আমল দ্বারা দেখিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন সে নিষ্পাপ থাকে। মানুষ সাধারণত শিশুদের ভালোবাসে এবং আদর করতে চায় আর শিশুদের ভালোবাসার প্রতি ইসলাম অনেক জোর দেয়। আসলে শিশু একটি বীজের মতো। আমরা যত বেশি এর পরিচর্যা করব, এর ফুল ও ফল তত ভালো হবে। আমরা জানি, নবী করিম (সা.) শিশুদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন, তাদের কাছে টেনে চুমু খেতেন, তাদের জন্য সর্বদা কল্যাণ ও মঙ্গলের দোয়া করতেন। এমনকি নামাজের সময় দুষ্টামি করলেও তাদের কিছু বলতেন না। একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) একবার হাসানকে (তার দৌহিত্র শিশু) চুমু খেলেন। তখন নবী করিমের (সা.) সঙ্গে ছিলেন হযরত আকরা ইবনে হাবিস (রা.)। তিনি বিরক্তি ভরে বললেন, 'আমার ১০টি সন্তান রয়েছে, আমি কাউকে কোনোদিন চুমু খাইনি।' এ কথা শুনে নবী করিম (সা.) তার দিকে তাকিয়ে করুণা ভরে বললেন, যে দয়া করে না সে দয়া পায় না' (বোখারি)। অন্য একটি হাদিসে আনসারদের দেখতে গিয়ে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) তাদের শিশুদের সালাম দিতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তাদের জন্য সর্বদা দোয়া করতেন (নাসাঈ)। অথচ ইসলামের এই সুমহান শিক্ষার বিপরীতে আজ অনেক লোককে দেখা যায়, তারা শিশুর শিশুসুলভ আচরণ কিছুতেই মেনে নিতে চান না। কারণে-অকারণে তাদের গায়ে হাত তুলতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। অথচ শিশুদের গায়ে হাত ওঠানোকে ইসলামে কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে। অবহেলিত শিশুদের প্রতি সমাজের সচেতন মানুষের সম্মিলিত সহানুভূতি একান্ত প্রয়োজন। ওদের প্রতি সামান্য সহানুভূতির ফলে আমরা খুব সহজে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারি। সমাজে বিশৃঙ্খলা করার কোনো শিক্ষা ইসলামে পাওয়া যায় না। ইসলাম আমাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন পরিহার করে বিনয়ী এবং নম্র হয়ে চলার শিক্ষা দেয়। সব ধর্মই চায় শান্তি, সব মানুষ চায় শান্তি অথচ আজ প্রতিটি মানুষ চরম অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। যতদিন মানুষ মানুষকে না ভালোবাসবে, ততদিন পৃথিবী অশান্তই থাকবে, পৃথিবী স্বর্গরাজ্যে পরিণত তখনই হতে পারে, যখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে।