সততা ন্যায়পরায়ণতা ও শুদ্ধি অভিযান

দুর্ভাগ্য দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। বাংলাদেশ একসময় দুর্নীতির জন্য পর পর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দুর্নীতির সেই কলঙ্ক-তিলক মোচন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি এটা যেমন সত্য, একইভাবে সত্য আমরা সমাজ-রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারিনি। যার কারণে আমাদের আশানুরূপ উন্নতি অগ্রগতি হয়নি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। আশার কথা, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তার রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি।

প্রকাশ | ২৩ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
সমাজের সর্বত্র চলছে নীতিহীনতার জয়জয়কার। এর ফলে সত্য ন্যায়পরায়ণতা ঢাকা পড়ে গেছে অবলীলায়। আগে পাঠ্যপুস্তকে নীতিকথা ছিল। নীতিকথা থাকা মানে হচ্ছে, ব্যক্তিজীবনে তা অনুসরণ করা। কেবল পাঠ্যপুস্তকে নয়- গুরুজন বা অভিভাবকরা শিশু-বয়স থেকেই শেখান এবং সাবধান করে দেন, সন্তানরা যাতে অসৎ পথে না চলে। ব্যক্তি সৎ ন্যায়নিষ্ঠ কর্তব্যপরায়ণ বলেই তার প্রভাব পড়ে পরিবারে, সমাজে। ব্যক্তির চরিত্র ও মানসগঠনে সততা এক অপরিহার্য শর্ত। প্রাচীন একটি সত্যবাদিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে দেয়া জরুরি, সচেতন পাঠকমাত্রই এ ঘটনা জানেন। যুগে যুগে যা উচ্চারিত হয়ে আসছে। বর্তমান ইরানের জিলান অঞ্চল থেকে বাগদাদমুখী এক কাফেলা পথিমধ্যে মরুদসু্যদের কবলে পড়ল। কাফেলার সদস্যদের সঙ্গে দসু্যদলের সংঘর্ষ হলো। কিন্তু অল্পক্ষণেই তারা দসু্যদের কাছে পরাজিত হলো। এরপর শুরু হলো লুটপাট। একে একে কাফেলার সবাই তাদের অর্থ, মূল্যবান জিনিসপত্র দসু্যদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলো। দসু্যদের কয়েকজন এক পাশে শান্তভাবে উপবিষ্ট সাধারণ চেহারা এক বালকের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল- 'তোমার কাছে কি কোনো কিছু আছে?' বালক উত্তর দিল, 'হঁ্যা, আমার কাছে ৪০টি দিনার আছে।' দসু্যরা এ কথা শুনে বালকের কাপড়-চোপড়, বিছানা তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করল। কিন্তু কিছুই পেল না। তারা ভাবল, বালকটি তাদের বোকা বানিয়েছে তারা অন্যদের তলস্নাশি করতে চলে গেল। তলস্নাশি শেষ করে এবং লুটের মালামাল এক জায়গায় জড়ো করে দসু্যরা অদ্ভুত বালকটির কথা তাদের সরদারকে জানালো। বালককে সঙ্গে সঙ্গে সরদারের কাছে উপস্থিত করা হলো। সরদার তাকে জিজ্ঞাসা করল- 'তুমি নাকি বলেছ, তোমার কাছে ৪০টি দিনার আছে?' বালক নির্ভীকচিত্তে জবাব দিল, 'হঁ্যা আছে।' সরদার পুনরায় জানতে চাইল, 'তাহলে দিনারগুলো কোথায়?' বালক সঙ্গে সঙ্গে তার জামার ভেতরের দিকে একটি অংশ খুলে দিনারগুলো বের করলে দসু্যরা বিস্মিত হলো। সরদার তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, 'কিন্তু তুমি তোমার মূল্যবান অর্থের কথা ফাঁস করে দিলে কেন? তুমি অন্যভাবে বললে তো কেউ তোমাকে সন্দেহ করত না।' বালকটি উত্তর দিল, 'আমার মা যিনি দিনারগুলো জামার ভেতর সেলাই করে দিয়েছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন কখনো মিথ্যা কথা না বলার জন্য।' বালকের অদ্ভুত ব্যবহারে দসু্য সরদার হতবাক হয়ে গেল যে, বালকটি বিপদের মধ্যে পড়েও তার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করেছে। তার জন্য এটা ছিল এক মহান অভিজ্ঞতা এবং তার জীবনের মোড় পরিবর্তনের জন্য অনিবার্য ছিল। সরদার জানালো, 'এই ছোট্ট বালক তার মায়ের প্রতি কত অনুগত, আর আমি সৃষ্টিকর্তারও অবাধ্য।' সরদারের হৃদয় বিষাদে ভরে গেল এবং তার চোখ দিয়ে অশ্রম্ন ঝরতে লাগল। সরদার কাফেলার সদস্যদের তাদের কাছ থেকে লুণ্ঠিত মালামাল ফেরত দেয়ার জন্য দসু্যদের নির্দেশ দিয়ে দসু্যবৃত্তির ঘৃণ্য জীবন চিরতরে পরিত্যাগ করল। এই বালকের নাম আবদুল কাদের। ইসলামী বিশ্বের বিখ্যাত সাধকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি এবং সারা মুসলিম বিশ্বে 'বড়পীর' হিসেবে খ্যাত। এই গল্প বলার অর্থ এই যে, সমাজে এমনও মানুষ রয়েছে, যিনি মিথ্যা, প্রতারণা, ছলচাতুরী এসবের মধ্যে নেই। সংখ্যায় কম হলেও সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ সমাজে এখনো রয়েছে। একজন মানুষ যদি কেবল সত্য কথা বলে তাহলে তার পক্ষে কোনো অন্যায় কাজ করাই সম্ভব নয়। আমাদের নবী করিম (সা.) আল-আমিন খেতাব পেয়েছিলেন। সে জন্য কাফেররাও তাদের মূল্যবান মালামাল গচ্ছিত রাখত। কেউ কেউ এও বলেন সমাজে ন্যায়পরায়ণতা ও সততা রয়েছে বলে সমাজ এখনো টিকে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান সমাজ কতটা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। একজন রিকশাচালক বললেন, 'ঢাকা শহরের সবাই খালি মিথ্যা কথা কয়।' এর সরল অর্থ হচ্ছে নাগরিক জীবন মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। মিথ্যা বলে অসততার আশ্রয় নিয়ে দুর্নীতি, দখল চাঁদাবাজির মাধ্যমে মানুষ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। সম্প্রতি ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি এবং যুবলীগের নানা অপকর্মই এর প্রমাণ। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন, যাদের কাজ ছিল জনকল্যাণ নয়- দখল চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা হত্যা লুটপাটের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করা। আশার কথা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে, দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলছে। এই অভিযানের একমাস অতিক্রান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকেই ধরা পড়েছেন। তাদের বিভিন্ন অপরাধ বেরিয়ে এসেছে। এরা বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা। তবে এ বিশেষ অভিযানে সরাসরি দায়িত্ব পালন করছে এলিট ফোর্সর্ যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্(যাব)। উলেস্নখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করের্ যাব, যাকে বলা হচ্ছে সরকার ঘোষিত শুদ্ধি অভিযান। এ অভিযান শুরু থেকেই পেয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন, জনমনে সৃষ্টি করেছে আস্থা। এক মাস ধরে চলমান এ অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮ জনকে। নগদ সাড়ে আট কোটি টাকাসহ জব্দ করা হয়েছে প্রায় ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর। এ পর্যন্ত ১১টি ক্যাসিনো/ক্লাবে অভিযান পরিচালনা করেছের্ যাব, যার মধ্যে রাজধানীতে আটটি ও চট্টগ্রামে রয়েছে তিনটি। এসব ক্লাব থেকে উদ্ধার করা ক্যাসিনো সামগ্রীর দাম কয়েক কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত এক মাসে ক্লাব, বাসাবাড়ি ও অফিসসহ মোট ১৯টি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে এই অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত। দুর্ভাগ্য দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। বাংলাদেশ একসময় দুর্নীতির জন্য পর পর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দুর্নীতির সেই কলঙ্ক-তিলক মোচন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি এটা যেমন সত্য, একইভাবে সত্য আমরা সমাজ-রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারিনি। যার কারণে আমাদের আশানুরূপ উন্নতি অগ্রগতি হয়নি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। আশার কথা, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তার রয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি। ইতিমধ্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় বাধা। দুর্নীতির কারণেই আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বেতন দ্বিগুণ করেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের লোভ ও মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুদকের বর্তমান তৎপরতার মাধ্যমে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা অনেক কঠিন কাজ। এখন যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে এটা তো নতুন কিছু নয়। দুর্নীতি বাংলাদেশে আগেও ছিল এখনো আছে। এখন যে দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযান চলছে, ঠিকমতো তলস্নাশি চালালে এমন শত শত নেতার ঘর থেকে টাকার খনি বেরিয়ে আসবে। তা হলে ব্যাংকের বাইরে কী পরিমাণ টাকা রয়েছে এবং কত টাকা পাচার করা হয়েছে ভাবতে অবাক লাগে। প্রশ্ন হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কত টাকা প্রয়োজন। দেশের সবাই যদি অবৈধভাবে কোটিপতি হতে চায় তা হলে এটা একটা বিপজ্জনক বার্তা। এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এখন বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল, বলা হয় এশিয়ার বাঘ। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। একাত্তরের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশের বিদু্যৎ সংকট সিংহভাগই কেটে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সরকার দেশের ইপ্সিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারও অনেক বেড়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর হার কমেছে। মুদ্রাস্ফীতি নেমে এসেছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে। তথ্য-প্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আশাব্যঞ্জক অবস্থানে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে 'ভিশন ২০২১' ও 'ভিশন ২০৪১' কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার, যা সফল হওয়ার পথে। শুধু দেশেই নয়- আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর স্বীকৃতি মিলেছে। আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। এ জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশালী ও গর্বিত দেশ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সমহিমায় তার উজ্জ্বলতা নিয়ে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক