আমরা কতটা প্রস্তুত?

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। নাগরিক সুযোগ সুবিধার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। এছাড়া ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিপূবের্ অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর করুণ অবস্থাই এই জরিপের সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট।

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

ড. হারুন রশীদ
বাংলাদেশ ভ‚মিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। বিজ্ঞানীদের এই কথা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। ভূমিকম্পের আঘাত থেকে বঁাচতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। ভূমিকম্প বলে-কয়ে আসে না। কিন্তু এ জন্য করণীয় রয়েছে। এ জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত সে ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ভূমিকম্প এমন একটি দুযোর্গ যার পূবার্ভাস এখনো বিজ্ঞানীরা দিতে পারছে না। তবে নানা গবেষণায় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের কথা উঠে এসেছে বার বার। বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশ এখন কোনোমতেই ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ গত ৮০-৮১ বছরে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান প্লেট যাচ্ছে উত্তর দিকে, আর উত্তর দিকে আমাদের ইউরেশিয়ান প্লেট। দুটি প্লেট ধাক্কা দিচ্ছে, আর তাতে করে এর বাউন্ডারিতে এনাজির্ স্টোর হচ্ছে। বেশ কিছুদিন পরপর প্রেসারটি রিলিজ করার জন্য জায়গাটি নড়ে যায়, আর তখন ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। বিল্ডিং কোড মেনে না চলা, বন উজাড়, পাহাড় কেটে ধ্বংস করাসহ নানা উপায়ে আমরা যেন ভূমিকম্প নামক মহা বিপদকে ডেকে আনছি। সত্যি বলতে কি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। বিল্ডিং কোড মেনে না চলা, বন উজাড়, পাহাড় কেটে ধ্বংস করাসহ নানা উপায়ে আমরা যেন ভূমিকম্প নামক মহা বিপদকে ডেকে আনছি। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সারা দেশে ঝুঁকিপূণর্ ভবনের সংখ্যা লক্ষাধিক। একই সাথে পাশ্বর্বতীর্ দেশগুলোতে ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ভূমিকম্পনেও বাংলাদেশের ক্ষতি হতে পারে বলেও বিশ্লেষকরা বলছেন। এ ক্ষেত্রে নতুন ভবন নিমাের্ণ সরকারি তদারকি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বার বার ভূমিকম্প এ কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, দুযোর্গ মোকাবেলায় আমরা আসলে কতটা প্রস্তুত। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশে প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। রাজধানীতে দিন দিন বাড়ছে আকাশচুম্বী অট্টালিকার সংখ্যা। অল্প জায়গায় এতো বড় বড় স্থাপনা ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা হচ্ছে ভবন। এতে স্বল্পমাত্রার কম্পনেই ভেঙে পড়তে পারে অনেক ভবন। এ ছাড়া ভূমিকম্প-পরবতীর্ দুযোর্গ মোকাবেলায়ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। তৈরি করতে হবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। জনসচেতনতার জন্য চালাতে হবে ব্যাপক প্রচারণা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুযোর্গ ভূমিকম্প রোধ করা সম্ভব নয়, তবে আমরা প্রকৃতির ওপর অবিচার করে নিজেরাই যেন ভূমিকম্প ডেকে না আনি সে বিষয়ে সতকর্ থাকার কোনো বিকল্প নেই। ভেতরে ও বাইরে থেকে ভ‚মিকম্প সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশ ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁুকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এসব ভ‚মিকম্পের মধ্যে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভ‚মিকম্পও রয়েছে। যদিও এখন পযর্ন্ত এসব ভ‚কিম্পে বড় মাত্রার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, না হলেও দেশের চারদিকে ভয়াবহ ভ‚মিকম্পবলয় তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে উত্তর ও উত্তর-পূবর্ ভারতে বাংলাদেশের জন্য অশনি সংঙ্কেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব এলাকা থেকে প্রায় সময়ই মাঝারি মাত্রার ভ‚মিকম্পের উৎপত্তি হচ্ছে। এর আঘাত সরাসরি এসে পড়ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর। অতীতের মতো সাম্প্রতিককালেও এসব এলাকা থেকে বড় ভ‚মিকম্প সৃষ্টি হওয়ার নজির রয়েছে। বিশেষ করে সিকিম, উত্তর পূবের্ আসাম ও এর আশপাশে এলাকা থেকে এখন প্রায়ই ভ‚মিকম্প সৃষ্টি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘন ঘন ভ‚মিকম্পের কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বড় ধরনের ভ‚মিকম্প সংগঠিত হওয়ার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে ভূ অভ্যন্তরে অধিক শক্তি জমা হয়েছে। যে কোনো মুহূতের্র ভ‚মিকম্পের মাধ্যমে তা বের হয়ে আসবে। ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুযোর্গ যার পূবাভাস আগে থেকে জানা যায় না। এ ছাড়া একে আটকাবার কোনো পথ নেই। এ অবস্থায় সচেতনতা এবং সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুযোর্গ মোকাবেলায় বাংলাদেশ অনেক দূর অগ্রসর হলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভূমিকম্পকে মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুতিতে আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায় আর এজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। জাতীয় উদ্যোগ নিতে হবে ভূমিকম্পের সময় ও তারপর কি কি করণীয় সে সম্পকের্ মানুষকে সতকর্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে। ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারি পযাের্য় ব্যাপক প্রচারাভিযান। সরকারি উদ্যোগে ফায়ার সাভির্স, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। ভূমিকম্পের সময় দালান ভেঙে পড়ে বেশি মানুষের ক্ষতি হয়। তাই নিমার্ণাধীন বাড়িগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হচ্ছে কি-না কতৃর্পক্ষের সে ব্যাপারে তদারকি জোরদার করতে হবে। উপক‚লীয় এলাকা যেখানে সুনামি, ভূমিকম্পÑ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুযোের্গ ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে সেখানে তৈরি করতে হবে অনেক আশ্রয়কেন্দ্র, যাতে করে মানুষ বিপদের সংকেত পাওয়া মাত্রই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে ভূমিকম্প হলে উত্তেজিত না হয়ে সাবধানে সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে। আর তাই সতকর্তামূলক ব্যবস্থাগুলো সম্পকের্ মিডিয়াতে আরও প্রচার চালাতে হবে। কেবল জনসচেতনতাই যথেষ্ট নয় পাশাপাশি এদেশের বিশেষজ্ঞরা যেন ভূমিকম্পের ওপর গবেষণা করার সুযোগ পায় এবং ভূমিকম্পের পরিমাণ নিণর্য় করার উপযুক্ত প্রযুক্তি পায় সে দিকেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে মনোযোগ দিতে হবে। ভূমিকম্প রোধের ক্ষমতা যেহেতু আমাদের হাতে নেই সেহেতু বিপযর্য় মোকাবেলার সক্ষমতা বাড়িয়ে ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করতে হবে। সময় থাকতে কাজ না করলে ঘটনা ঘটার পরে আমাদের চরম মাশুল দিতে হয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা সকলের সচেতনতা বৃদ্ধিতে যে যার জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। শুধু প্রাকৃতিক কারণেই নয় পাহাড় কাটা এবং বন ধ্বংসের কারণেও ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের আত্মবিনাশী কমর্কাÐও বন্ধ করতে হবে। দুই. একটি নগরে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য নগরজীবনকে স্বচ্ছন্দ, পরিবেশবান্ধব, টেকসই, উন্নয়নমুখী এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কেননা দেশের এক-তৃতীয়াংশ অথার্ৎ প্রায় ৫ কোটি মানুষ এখন শহরে বাস করছে। আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বোঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। কোথায় স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল হবে, অফিস-আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা সবকিছুই হবে পরিকল্পনামাফিক। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূণর্ নাগরিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। এতে তার নাগরিক জীবন হয় মযার্দাপূণর্, গ্রাম কিংবা মফস্বলের তুলনায় উন্নততর, স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এ নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে হঠে। জনজীবনকে তা বিপযর্স্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। দুঃখজনক হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় বার বার ঢাকার নাম উঠে আসছে বিভিন্ন জরিপে। আমাদের রাজধানী শহর বসবাসের অনুপযোগী-এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! এ অবস্থা যে আমাদের জন্য গৌরবজনক নয় সেটি কি বলার অপেক্ষা রাখে? একটি শহরের মান নিণের্য়র ক্ষেত্রে যে নিয়ামকগুলো কাজ করে এর মধ্যে রয়েছে- নগরীতে বসবাসের সুযোগ-সুবিধা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধা, অপরাধের হার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোর গুণগতমান, পানি সরবরাহের মান, খাদ্য, পানীয়, ভোক্তাপণ্য এবং সেবা, সরকারি বাসগৃহের প্রাপ্যতা ইত্যাদি। এসব দিক থেকে ঢাকাসহ আমাদের নগরগুলোর কী অবস্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। নাগরিক সুযোগ সুবিধার অনেক কিছুই এখানে অনুপস্থিত। এছাড়া ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিপূবের্ অন্য জরিপে প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর করুণ অবস্থাই এই জরিপের সত্যতা প্রমাণে যথেষ্ট। এ ছাড়া যানজট, যানবাহন এবং কলকারখানার কালো ধেঁায়া, খাদ্যে ভেজাল, সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমানও ঢাকার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে ন্যূব্জ এই শহরে নেই পয়ঃনিষ্কাষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা। জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি-ঘোড়া। কিন্তু সে তুলনায় রাস্তাঘাট, হাসপাতাল স্কুল-কলেজ, গ্যাস, বিদ্যুত, পানি ইত্যাদি নাগরিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুতেই পরিকল্পনাহীনতার ছাপ। অথচ রাজধানী ঢাকাই দেশের অথৈর্নতিক কমর্কাÐের প্রাণকেন্দ্র। এ জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা আবাসস্থল থেকে পরিণত হয়েছে বিরাট বাজারে। বস্তুত এই শহরের সুনিদির্ষ্ট কোনো চরিত্র নেই। যত্রতত্র যে যেখানে পারছে যে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এতে নগরী তার বিশিষ্টতা হারাচ্ছে। এক জগাখিচুড়ি অবস্থায় রাজধানীবাসী এখানে বাস করছে। ফলে অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ঢাকা নয় দেশের অন্যান্য শহরকেও পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। সুষম উন্নয়ন করতে হবে গ্রামেও। শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স