খাদ্যের মান ও দাম

পেঁয়াজসহ খাদ্যদ্রব্যের বাজার আসলে কারা নিয়ন্ত্রণ করে? এসব মৌলিক নাগরিক অধিকার নিয়ে যেভাবে ইচ্ছেমতো কারসাজি হচ্ছে সেটা কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া সম্ভব নয়।

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মাহমুদুল হক আনসারী
সমাজ ও রাষ্ট্রে সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নাগরিকের স্বাস্থ্যসম্মত জীবন বাঁচাতে খাদ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সাংবিধানিক অধিকার। খাদ্যের মান রক্ষা করা মনিটরিং এটা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাজে বিভিন্ন পেশা ও শ্রমের মানুষের বসবাস। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ জীবিকার সন্ধানে বাসাবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। অফিস-আদালত কোর্ট-কাচারিতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের কর্মব্যস্ততা থাকে। ফলে এসব কর্মময় মানুষ বেঁচে থাকার তাগাদায় হোটেল রেস্টুরেন্টের শরণাপন্ন হয়। টং দোকান থেকে আভিজাত রেস্টুরেন্ট হোটেল যেটায় হোক, ওইসব রেস্টুরেন্টে জনগণকে যেতে হয়। কিন্তু এসব খাদ্য রেস্টুরেন্টের তৈরি, পরিবেশন, দাম ও মান নিয়ে অভিযোগের শেষ থাকে না। পচা- বাসি খাবার থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন মানের ময়দা মেয়াদোত্তীর্ণ পোড়া তেল ব্যবহার করে এসব খাদ্য জনগণকে খাওয়াতে দেখা যায়। উপরে চাকচিক্য রেস্টুরেন্টের নামদাম থাকলেও ভেতরে ভেজালে ভরপুর। পোড়া তেল নিম্নমানের আটা-ময়দা দিয়ে তেলে ভাজা ফাস্টফুড ছাত্র থেকে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে চড়া দামে খাওয়ানো হয়। এসব নাস্তার আইটেমের নামে ভিন্নতা হলেও দামের মধ্যে চড়া তফাৎ দেখা যায়। গরু, মুরগি, খাসি মাংসের মধ্যে বিরাট ভেজাল এখানে লক্ষ্য করা যায়। চড়া দাম দিয়ে খেতে হয় জনগণকে। ফার্মের মুরগি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে হলেও ছোট আকারের ২ পিস মুরগির সাধারণ হোটেলে দাম নেয়া হয় ১০০ টাকা। আর যদি সেটা দেশি মুরগি হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে তার মূূল্য বেড়ে হবে ২০০ টাকা। গরুর মাংসের কথা বলে মহিষের মাংস বিক্রি করার নজির অহরহ। সে ক্ষেত্রে মাত্র ছোট ছোট ৬ পিস গরু মাংসের দাম নেয়া হয় ১৫০ টাকা। এভাবে অন্যান্য যেসব খাবার হোটেল রেস্টুরেন্টে পরিবেশন করা হয় সবগুলোর দাম প্রায় তিনগুণ বলা যায়। একটা রেস্টুরেন্টের খাদ্য আইটেমের মূূল্য তালিকার সঙ্গে আরেকটা হোটেলের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ইচ্ছেমতো দাম নিয়ে জনগণের চরমভাবে পকেট কাটা অব্যাহত আছে। মাছ, মাংস পরিবেশনে ব্যাপকভাবে ভেজাল কারচুপি অহরহ। একজন সাধারণ মানুষ একটি সাধারণ খাদ্য রেস্টুরেন্টে কমপক্ষে সাধারণভাবে খেলেও তার এক থেকে দেড়শত টাকা দরকার হয়। কিন্তু যে খাদ্য একজন মানুষ হোটেল থেকে গ্রহণ করেছে তার মূল্য ৪০ টাকার উপরে আসার কথা নয়। এভাবে হোটেল রেস্টুরেন্টে পচা-বাসি খাবারের সঙ্গে যে পরিমাণ দাম হাতিয়ে নিচ্ছে তা যেন দিব্যি চোখ বোজে আমরা গ্রহণ করে যাচ্ছি। শ্রমজীবী পেশাজীবী মানুষ থেকে ভিআইপি জনগণও এসব হোটেল রেস্টুরেন্টের অথবা ফাস্টফুড দোকানের খাবার গ্রহণ করে যাচ্ছে। কিন্তু এসব খাবারের মান আর মূল্য নিয়ে কারো বাদ-প্রতিবাদ নেই বললেই চলে। যা হোটেল মালিকরা চায় তাই দিয়ে জনগণ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে। কেননা, এত দাম নেয়া হয় একবারের জন্যও কোনো হোটেল গ্রাহককে বলতে দেখা যায় না। যারা নিয়মিতভাবে হোটেল রেস্টুরেন্টে খেয়ে জীবন জীবিকার সন্ধান করে তাদের জন্য এ মূল্য অনেক কঠিন ও কষ্টকর। কিন্তু যারা মাঝেমধ্যে হোটেল রেস্টুরেন্টের শরণাপন্ন হয় তাদের কথা না চিন্তা করলেও যাদের নিয়মিত রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হয় অবশ্যই তাদের জন্য সমাজকে চিন্তা করতে হবে। এসব হোটেলের খাদ্য তৈরি, বিক্রি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনা করে মূল্য নিলে কোনো সমালোচনার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত মূল্য নিয়ে জনগণের পকেট কাটা কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া যায় না। এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দেখা দরকার আছে। শুধু হোটেলের কথা কেন? হাট-বাজারের কথাও চিন্তা করতে হবে। মুদির দোকান থেকে ওষুধের ফার্মেসি পর্যন্ত কেউই সঠিক শৃঙ্খলা মতো ব্যবসা করছে না। একেই চাউল, পাশাপাশি দু'টি দোকানে ২০০ টাকার পার্থক্যে বিক্রি করা হয়। এক দোকানে একই চাল ১৮০০ টাকা হলে পাশের দোকানে সেই চাল ২০০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। মূল্যহীন প্যাকেটজাত খাদ্য দ্রব্য ছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্য এভাবে ইচ্ছেমতো দাম দিয়ে বিক্রি করতে অনেক হাট-বাজার দোকানে মার্কেটে দেখা যায়। সারাদেশে এখন পেঁয়াজের মহামারি চলছে। পত্রিকার সংবাদে দেখা যায়, প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে টনে টনে পেঁয়াজ দেশে ঢুকছে। কিন্তু পেঁয়াজ গ্রাহকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন পেঁয়াজের খুচরাবাজারে মূল্য ছিল কেজি ১২০ টাকা। আবার সেটা সব দোকানিরা একই দামে বিক্রি করছে না। কোনো কোনো দোকানদার ৯০/৯৫ টাকাও বিক্রি করতে দেখা গেছে। তাহলে আসলে কোনো জায়গায় পেঁয়াজের সংকট সেটা ভোক্তারা বুঝে নিতে পারছে না। পেঁয়াজসহ খাদ্যদ্রব্যের বাজার আসলে কারা নিয়ন্ত্রণ করে? এসব মৌলিক নাগরিক অধিকার নিয়ে যেভাবে ইচ্ছেমতো কারসাজি হচ্ছে সেটা কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের এতগুলো সংস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন জনগণের মৌলিক অধিকার খাদ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সেটা বোধগম্য নয়। কোথায় সিন্ডিকেট, কোথায় কারসাজি সেটা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে। এতগুলো পেঁয়াজ দেশে ঢুকছে, কোথায় গিয়ে এগুলো গুদামজাত হয় তাও রাষ্ট্রকে খবর রাখতে হবে। জনগণের জীবন রক্ষা করা তাদের খাদ্যের পর্যাপ্ত অধিকার নিশ্চিত করা শাসকদলের অন্যতম দায়িত্ব। জনগণের রুজি রোজগারের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব দেখতে হবে। আয় ব্যয় সঠিক পন্থায় জনগণ তার জীবন জীবিকা পরিচালনা করতে না পারলে সেখানে পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সুতরাং খাদ্যের মান ও মূল্য সবকিছু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। মাহমুদুল হক আনসারী: গবেষক, প্রাবন্ধিক