প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্য

এ কথা সত্য, বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়- দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে একটি মডেল দেশ। বাংলাদেশের অবস্থান এমন এক এলাকায় যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্য-ঘটনা। গত ৫০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এ দেশে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ।

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুল তান্ডব চালিয়েছে। এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে উপড়ে গেছে বহু গাছ, বিধ্বস্ত হয়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি। ভারী বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের খেত। অনেক জায়গায় পোল ভেঙে বিদু্যৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফসল ও মাছের। মোট আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ৭০ হাজার সরকারি হিসাবে। আর বেসরকারি হিসাবে ২০ লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ২০টি। ঘূর্ণিঝড়ের সময় দমকা হাওয়ায় গাছ ও ঘর চাপা পড়ে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে, ট্রলার ডুবিতে ১০ জেলায় অন্তত ২৬ জনের মৃতু্য হয়েছে। প্রায় ৪৭ কোটি টাকার মাছ নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ঘেরের মাছ। ২ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল ঝড়ের কবলে পড়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ জেলা। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে আহত হয়েছেন ২৫ জন। এদের মধ্যে ১২ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। সুন্দরবনের কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি সুন্দরবনের উপর দিয়ে আসায় গতি-শক্তি অনেকটাই কমে গেছে। ফলে বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। ঝড়টি সুন্দরবন না হয়ে বরিশাল এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হলে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতো। অতীতেও সুন্দরবন বহুবার নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ষা করেছে দক্ষিণ জনপদকে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার গতি-শক্তিও অনেকটাই কমে গিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের কারণে। বন বা গাছ যে কত উপকারী ঘূর্ণিঝড়-প্রতিরোধী তা এবার বোঝা গেল নতুন করে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'এই ঝড়ের মোকাবিলা করার জন্য, মানুষকে রক্ষা করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া আছে। এমনকি ঝড় পরবর্তী রিলিফ কার্যক্রম যাতে চালানো যায়, সে ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি।' ঘূর্ণিঝড় 'বুলবুল' মোকাবিলার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে সরকার সক্ষম হওয়ার কারণে ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়েছে। এবার ছুটি বাতিল করা হয় কর্মকর্তাদের। ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে এবং এলাকার মানুষকে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও উলেস্নখ করার মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্ঘুম রাত কাটান সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষেত্রে আগাম প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা এবং এর আগে ফণীসহ আরও কিছু ঘূর্ণিঝড়ে সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে ক্ষয়-ক্ষতি কম হওয়া থেকে যে বিষয়টি প্রমাণিত সত্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং আগের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। একটা সময় ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানেই ছিল ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদহানি। তখন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করত। কিন্তু সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। এবার ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি এড়াতে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ১৮ লাখ মানুষকে ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় 'বুলবুল' পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষয়-ক্ষতির শঙ্কায় উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য অন্যান্য জাহাজসহ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর আক্রান্ত এলাকায় পুলিশ, বিজিবি,র্ যাব ও সেনাবাহিনী দ্রম্নততার সঙ্গে উদ্ধার কাজ শুরু করায় উপদ্রম্নত এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, এর আগে ২০০৯-এর ২৫ মে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে একযোগে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় এবং তার সঙ্গে বিশাল জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায়, ভেঙে পড়েছিল অসংখ্য গাছপালা। অনেকে মনে করেছিল, আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না সুন্দরবন। কিন্তু সে ভুল ভেঙে দিয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমিখ্যাত সুন্দরবন। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল উপকূল অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। ওই ঝড়ে (আইলা) কেবল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে ৩৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছিল। প্রায় ১০ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। তখন কয়েক লাখ বাড়িঘর জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। সেই ভয়াবহ ক্ষত এখনো পুরোপুরি মোছা সম্ভব হয়নি। এ কথা সত্য, বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়- দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে একটি মডেল দেশ। বাংলাদেশের অবস্থান এমন এক এলাকায় যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্য-ঘটনা। গত ৫০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এ দেশে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ। উলেস্নখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড় থেকে জনগণের জান-মাল রক্ষায় ১৭২টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। তা ছাড়া ৩২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবক, ২৪ লাখ আনসার ভিডিপি, ১৭ লাখ স্কাউট, ৪ লাখ বিএনসিসি, গার্লস গাইডের প্রায় ৪ লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য রয়েছে। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় তারা সদাপ্রস্তুত। তা ছাড়া সমুদ্র উপকূলের ৩৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন সেন্টার বর্তমান সরকার নির্মাণ করেছে। আরও ১৬৫৪টি নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় জনসচেতনতা এবং মাঠপর্যায়ে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলা বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক গঠন করার পাশাপাশি ৬২ হাজার প্রশিক্ষিত নগর স্বেচ্ছাসেবক গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে ৩২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামীতেও যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা ও এর ঝুঁকি হ্রাস করতে বাংলাদেশ সক্ষম হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালি জাতির অতীত গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্য সাহস ও সংগ্রামের।। সে ঐতিহ্য মানবিক চেতনাবোধের। নানা বৈরী পরিবেশ ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও জাতি হিসেবে বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অদম্য সাহসী এ দেশের মানুষ। তাদের প্রতিরোধ বা প্রতিহত করা অত্যন্ত কঠিন। অতীতে তারা নানা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রমাণ করেছে। প্রতিনিয়ত তারা ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও টিকে আছে। নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও বাঙালির মনোবল কখনো দুর্বল হয়নি, গয়ান হীনবল। দৃঢ় চেতা ও মনোবলসম্পন্ন বাঙালি জাতি সবসময় এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। কখনো বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, টর্নেডো, সাইক্লোন, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করেছে, কখনো বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাঙালি জাতি বারবার প্রমান করেছে তারা অদম্য। বিশ্বে দুর্যোগ ঝুঁকি তথা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ থেকে 'চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ' পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিশ্বে এখন আমরা শুধু উন্নয়নের রোল মডেল নই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল সে সম্মান পেয়েছে।' তার কথা সর্বাংশে সত্য। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে শুধু আর্থিক দিক থেকেই বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, শিশুরাও মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে। অনেক কোমলমতি শিশুর অকাল মৃতু্য হয়। চারদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। এক সময়ে আমরা শোক কাটিয়ে উঠি। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। তবুও আগাম প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি সরকার গ্রহণ করেছে, যা বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার নানামুখী কর্মসূচি ও উদ্যোগ গ্রহণ করায় সাধারণ জনগণের জানমাল যেমন এবার রক্ষা পেয়েছে তেমনি আগামী দিনেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক