সুয়েজ খাল: বিশ্ববাণিজ্যের কৃত্রিম ধমনি

প্রকাশ | ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ওয়াসেত সাহিন
সুয়েজ খাল শুধু জাহাজ চলাচলের সুবিধা প্রদান আর অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্যই প্রসিদ্ধ তা নয়। মরুভূমির মাঝ দিয়ে প্রবাহিত কৃত্রিম এ খালটার অপরূপ সৌন্দর্যও বিশেষায়িত করেছে মিসরকে।
সুয়েজ খাল। এর প্রকৃত নাম হচ্ছে 'হে সুয়েজ ক্যানেল'। আরবিতে একে ডাকা হয়, 'কা'নাত আল-সুয়াইস'। এটা ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। সুয়েজ খাল মিসরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটা কৃত্রিম সামুদ্রিক খাল। এটা যখন ছিল না তখন ইউরোপ থেকে ভারতে আসতে জাহাজগুলোকে সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হতো। এতে সময় লাগত চার থেকে পাঁচ মাস। কিন্তু এ খালটা সে সময়কে কমিয়ে দিয়েছে তিন থেকে চার সপ্তাহে। কারণ এ খাল খননের ফলে জাহাজগুলোর ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার দূরত্ব কমেছে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় দশ শতাংশ সমুদ্রবাণিজ্য এ খালের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এর খনন কাজ শুরু হয় ১৮৫৮ সালে এবং চলে প্রায় ১০ বছর। ১৮৬৯ সালে এটা সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। এই দীর্ঘ সময় খনন কাজ চলাকালে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। সুয়েজ খাল ভূমধ্যসাগরের পোর্ট আবু সাইদ থেকে লোহিত সাগরের সুয়েজ পর্যন্ত প্রলম্বিত। শুরুতে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার এবং গভীরতা ছিল ১৮ মিটার। চালুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এর বেশ কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ২০১০ সালের তথ্য মতে এর বর্তমান দৈর্ঘ্য ১৯০ কিলোমিটার, গভীরতা ২৪ মিটার এবং সর্বনিম্ন প্রস্থ ২০৫ মিটার। শুরুতে এ খালের প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল ছিল ৩০০ বর্গমিটার। পরে বিভিন্ন সময় তা বাড়ানো হয়। ১৯৭৫ সালে এই ক্ষেত্রফল দাঁড়িয়েছে ১৮০০ বর্গমিটার। \হনেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিসর অভিযানে আসার পর ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। কিন্তু ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগরের উচ্চতা ১০ মিটার বেশি হওয়ায় সে সময় খাল খননের চিন্তা বাদ দেয়া হয়। এরপরে ফার্দিনান্দ দি লেসেন্স নামে একজন ফরাসি প্রকৌশলী সুয়েজ খাল খননের উদ্যোগ নেন। এ জন্য ১৮৫৮ সালে সুয়েজ খাল কোম্পানি গঠন করা হয়। সমগ্র বিশ্বের জন্য এটা উপযোগী ও কল্যাণকর বিবেচিত হলেও সে সময় ব্রিটিশরা এতে বাধা দেয়। ওরা ভেবেছিল যেহেতু ফরাসিদের নেতৃত্বে খালটা তৈরি হবে- তাই তারা পূর্ব শত্রম্নতার জের ধরে হয়তো ব্রিটিশদের এ খাল ব্যবহার নাও করতে দিতে পারে। এ ছাড়াও ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টিতে তাদের অনীহা ছিল। খাল খনন যাতে বাধাগ্রস্ত হয় সে জন্য ব্রিটিশরা ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংককে এই খাল খনন প্রকল্পে ঋণ দিতে নিষেধ করে। কিন্তু তখনকার মিসরীয় শাসক মোহাম্মদ সাইদ পাশা ইউরোপের কিছু ব্যাংক থেকে অতি উচ্চ সুদে বহু অর্থ ঋণ নিতে সক্ষম হন। ফলে এ বিশাল খালটার খনন কাজ সম্পন্ন হতে পারে। খালটা চালু হওয়ার পর ইউরোপের দেশগুলো লাভবান হলেও মিসরের অর্থনীতি বহু দেনার দায়ে দেওলিয়া হওয়ার পথে এগোতে থাকে। তখন মিসর সুয়েজ খালের অর্ধেক শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যা ক্রয় করে ব্রিটিশরা এর মালিকানায় ভাগ বসায় এবং এক সময় মিসরে সাম্রাজ্যবাদী শাসন কায়েম করে। ১৮৮২ সাল থেকে দীর্ঘ ৭৫ বছর এরা মিসর দখল করে রাখে। এক অভু্যত্থানের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে মিসরের ক্ষমতায় আসে জামাল আবদেল নাসের। তিনি ক্ষমতায় এসেই সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করেন। এর ফলে তৈরি হয় সুয়েজ সংকট। এই সংকটের কারণে খালটা ১৯৫৭ পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়াও আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৬৭-১৯৭৫ পর্যন্ত ৮ বছর সুয়েজ খাল বন্ধ থাকে। এ সময় ৪০টা জাহাজ ডুবিয়ে এ খালে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখে মিসর। ১৯৭৫ সালে এতে পুনরায় জাহাজ চলাচল শুরু হয়। জাহাজ চলাচলের জন্য সুয়েজ খালটা এক লেন বিশিষ্ট। এতে একের অধিক জাহাজ পাশাপাশি যাতায়াত করতে পারে না। এ জন্য জাহাজের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে খালের পাশে বাইপাস ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বালস্নাহ বাইপাস এবং গ্রেট বিটার লেক। এই সুয়েজ খাল তৈরির ফলে বিশ্ববাণিজ্য সহজীকরণ, সময় ও অর্থসাশ্রয়ী হয়েছে এবং একইসঙ্গে একক দেশ হিসেবে মিসর হয়েছে অধিক লাভবান। এই খালের মাধ্যমে মিসর বিশাল অংকের অর্থ উপার্জন করে থাকে। এশিয়া ইউরোপ তথা বিশ্ব অর্থনীতিতে সুয়েজ খালের রয়েছে ব্যাপক অবদান। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১২ সালে এই খাল দিয়ে যাতায়াত করেছে ১৭২২৫টা জাহাজ, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৪৭টা জাহাজ। সাম্প্রতিক সময়ে এ খালে আরো ৩৫ কিলোমিটার বাইপাস খনন করা হয়েছে। ফলে যাত্রাপথে জাহাজগুলোর অপেক্ষার সময় নেমে এসেছে ১৮ ঘণ্টা থেকে ১১ ঘণ্টায়। ২০২৩ সাল নাগাদ এই খাল দিয়ে দৈনিক ৯৭টা জাহাজ যাতায়াত করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে সুয়েজ খাল থেকে মিসরের আয় আরো প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই খালে কোনো গেট বা প্রতিবন্ধকতা নেই। ফলে এর মাধ্যমে সমুদ্রের পানি অবাধে প্রবাহিত হয়। সাধারণত বিটার লেকের উত্তর দিকের খালে শীতকালে উত্তরমুখী স্রোত প্রবাহিত হয়। আর গ্রীষ্মকালে প্রবাহিত হয় দক্ষিণমুখী স্রোত। সুয়েজ খাল শুধু জাহাজ চলাচলের সুবিধা প্রদান আর অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্যই প্রসিদ্ধ তা নয়। মরুভূমির মাঝ দিয়ে প্রবাহিত কৃত্রিম এ খালটার অপরূপ সৌন্দর্যও বিশেষায়িত করেছে মিসরকে। দুই পাড়ে বিস্তীর্ণ বালুরাশি আর মাঝে বয়ে চলা নীল পানির ধারা- এতে কৃত্রিম এই খালে হয়েছে প্রকৃতি অপরূপ। নীলনদ, সুয়েজ খাল আর পিরামিড- এ তিন মিলিয়ে মিসর পেয়েছে পৃথিবীর এক অনন্য বিরল বৈশিষ্ট। যুগে যুগে মানুষ প্রকৃতিকে নিজের বশে নিতে চেয়েছে, নির্মাণ করেছে অবিশ্বাস্য সব স্থাপনা। ভারতের তাজমহল, চীনের মহাপ্রাচীর- আরও কত কী!। সমুদ্র দখলে নিয়ে আবাসিক এলাকা তৈরি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে জমি বাড়িয়েছে নেদারল্যান্ডস। কিন্তু উপযোগিতা ও বিশ্ব মানবের কল্যাণে সুয়েজ খাল স্বমহিমায় উজ্জ্বল। গতিশীল বিশ্ববাণিজ্যে ভূমিকার কারণে কৃত্রিম এ সুয়েজ খাল নিঃসন্দেহে এক অনন্য মানব প্রয়াস। ওয়াসেত সাহিন: কলাম লেখক