হ্যালো লিডার হ্যালো মিনিস্টার

পেঁয়াজ কারসাজি চক্রের সবার প্রকাশ্যে বিচার হোক

বাংলাদেশ আজ নানা কারণে বিশ্বের রোল মডেল। যার পুরো কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দেয়া যায়। জনবান্ধব ও কল্যাণকামী একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বাংলাদেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সেই নেতৃত্বের সময় যারা নানাভাবে দেশে সংকট সৃষ্টি করতে চান বা মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে ফায়দা লুটতে চান তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সময়ের দাবি।

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সোহেল হায়দার চৌধুরী
পেঁয়াজ নিয়ে দেশব্যাপী নানা অপকর্ম করেছে কারসাজি চক্র। এই চক্র এতটাই শক্তিমত্তা দেখিয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে তাদের কাছে অসহায় মনে হয়েছে। এদের নগ্ন চাপে জনগণও ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছে। আতঙ্ক, অস্বস্তি এবং রাগ-ক্ষোভে অনেক পরিবার পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কারসাজি বা মজুদদার অসাধু চক্র ধাপে ধাপে পেঁয়াজের বাজারকে পূর্ণাঙ্গ অস্থিতিশীল করে ভয়ংকর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ আড়াইশ' টাকা ছাড়িয়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। এটা স্মরণাতীতকালের একটি রেকর্ডই শুধু নয়- এর ফলে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে তা আপাতত বিলীন মনে হলেও এটি বিষফোড়া হিসেবে দেখা দেয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এটা সত্য, পেঁয়াজ কারসাজির মধ্যে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে চেষ্টা দেশি বাজারে বা সুবিধাবাদী কারসাজি চক্রের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শুধু মুখে হুমকি দিয়ে বা যৎসামান্য কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু কারসাজি চক্র এতটাই শক্তিশালী ছিল, সরকার বা কোনো মহলের তোয়াক্কা তারা করেনি। সরকার পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয়ার পরেও তিন বা চারগুণ বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করার সাহস দেখিয়েছেন বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ী। রাষ্ট্রীয় সংস্থার অভিযানকে উপেক্ষা করে বা তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীরা দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই চক্রের অসভ্যপনা অমানবিক আচরণ মানুষের হৃদয়কে যেমন ব্যথাতুর করেছে তেমনি সরকারকেও কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জনগণ এই অসাধু কারসাজি চক্রের হোতা এবং এর সঙ্গে জড়িতদের মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছে। এই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হবে কি হবে না সেটা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর পেছনে চক্রান্ত আছে কিনা তা খুঁজে দেখতে এবং কারসাজিকারীদের বিচারের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে জনগণের ক্ষোভের আগুন কিছুটা হলেও নিবৃত্ত করতে পেরেছেন। তার নির্দেশনার পরে গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে কাজ করছে বলে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দারা কী তথ্য দেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রকাশ্যে ন্যায্য বিচার হলে জনগণ আশাবাদী হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও ত্বরিত পদক্ষেপের ফলে বিদেশ থেকে দ্রম্নত পেঁয়াজ আসায় আশার আলো দেখা দিয়েছে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। মানুষের যে কোনো সমস্যা-সঙ্কটে তিনি যেভাবে দ্রম্নততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেন তা দেশবাসীকে বিমোহিত করে। দেশবাসী মনে করে বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত স্থানে নিয়ে যেতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। কিন্তু সংকট এলেই শুধু তড়িঘড়ি করে আমদানি বা ব্যবস্থা নেয়ার বদলে আমাদের সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি বা সংকট প্রতিরোধের চিন্তাটিকে বোধ হয় এখন বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। পেঁয়াজ সঙ্কটে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও নির্দেশে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ভূমিকা, বিদেশ থেকে দ্রম্নততার সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানি করা, মানবতাবিরোধী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা সঙ্কটের সাময়িক সমাধান করবে। কিন্তু এর নেপথ্যের কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপকর্মকারী মানবতাবিরোধী অসাধু ব্যবসায়ীদের সাজা নিশ্চিতের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় গুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে জোরালোভাবে। একথা কে না জানে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের যে উৎপাদন তার তুলনায় চাহিদা বেশি। সে চাহিদার কারণে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। এবার আমদানি প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় এবং আগাম বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংকট বেড়েছে। বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয় জানলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় না জানতো বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথ পদক্ষেপ আরও আগে থেকে নিলে সংকট এতদূর গড়াতো না এবং মানুষও ভোগান্তি থেকে হয়তো মুক্ত থাকতে পারত। যাই হোক, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই মূলত এই সংকট শুরু। জানা যায়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য তিনগুণ বাড়িয়ে দেয় ভারত। এর দুই থেকে তিনদিনের মধ্যেই ৫০ টাকা কেজির পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে চরম অস্থিরতা তৈরি হয় বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজারে। মিয়ানমার, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যায়। আর এর জন্য দায়ী মুনাফালোভী মানবতাবিরোধী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলো। অভিযোগ আছে বাজারব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সরকারি ব্যক্তিদের কারণেই বাজারে সংকট তৈরি হয়। প্রসঙ্গক্রমে আসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও টিসিবির কথা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ স্পষ্টই বলেছেন, তিনি মন্ত্রী থাকাকালে সংকট তৈরির আগেই ব্যবস্থা নিতেন। কথাটি পুরোপুরি সত্যি। সাংবাদিক হিসেবে আমরা দেখেছি, বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে কতটা কঠোরতার সঙ্গে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তোফায়েল আহমদ। সে সময় ব্যবসায়ীদের তিনি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। সে নিয়ন্ত্রণের জায়গাটি কি সংকুচিত হয়ে পড়ছে? ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব না দেয়ার সাহস দেখানোর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। জনগণ চায়, বিভিন্ন সময়ে নানা অসিলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করার সঙ্গে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচিত হোক। আর তা না হলে জনগণ ধরে নেবে 'ডালমে কুচ কালা হায়'। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনকল্যাণমুখী বাজারব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এবং মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীদের থাবা থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য টিসিবি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই টিসিবি একদিকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না, অন্যদিকে তাদের সঠিক পথে পরিচালনার কাজটিও হচ্ছে বলে মনে হয় না। দেশে কোন পণ্যের কত চাহিদা, কোন পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ী নামক মানবতাবিরোধী অসাধুচক্র ফায়দা লুটবে, কোন পণ্য কোন সময়ে বেশি প্রয়োজন, কোন সময়টিতে সংকট হতে পারে, সে সংকট মোকাবিলার পথ কি, বাজারব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাধু-অসাধু কারা জড়িত ইত্যাদি নানা বিষয়ে টিসিবির পর্যালোচনা এবং সতর্কতা থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি দিনে দিনে রুগ্ন হয়েছে। এখনো এই টিসিবিকে কার্যকর করে নিয়মিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মনিটিরিং করা গেলে, জনগণের সমস্যা অনেকাংশেই মিটবে বলে মনে করা হয়। সে জন্য প্রয়োজন কঠিন সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে এখন ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেটির নাম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সে প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে কি কাজ করছে তারও পর্যালোচনা হওয়া দরকার। রাষ্ট্রের অর্থে যে সেব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়, সে সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র বা সরকারের ভাবনাকে কতটা মূল্যায়ন করে বা প্রতিষ্ঠান দুটির মর্যাদা রক্ষায় কি দায়িত্ব পালন করে তার বিস্তারিত জানা দরকার। দেশের ভোক্তারা নানাভাবে নির্যাতিত হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি তা নিরসনে কি করছে তা জানার অধিকার জনগণেরও রয়েছে। বাংলাদেশ আজ নানা কারণে বিশ্বের রোল মডেল। যার পুরো কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দেয়া যায়। জনবান্ধব ও কল্যাণকামী একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বাংলাদেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সেই নেতৃত্বের সময় যারা নানাভাবে দেশে সংকট সৃষ্টি করতে চান বা মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে ফায়দা লুটতে চান তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সময়ের দাবি। কেউ কেউ বলতে পারেন মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা। মুক্তবাজার অর্থনীতি মানে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা নয় বা বাজারব্যবস্থাকে শৃঙ্খলাহীন করা নয়। জনগণ এসব মুক্তবাজার বা অন্য বাজার অর্থনীতি নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যায় যেতে চায় না। তারা চায় তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত হবে। সে অবস্থান থেকে বলতে চাই মুক্তবাজার অর্থনীতি বা যুক্তবাজার অর্থনীতি যাই হোক না কেন, জনগণের চাহিদাকে মাথায় রেখে বাজারব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায়ী নীতিমালা নতুনভাবে সাজানো হোক। যারা নীতিহীনভাবে মানুষের বিপক্ষে গিয়ে দেশে সংকট সৃষ্টি করবেন সে সব ব্যবসায়ীদের 'মানবতাবিরোধী অপরাধী' হিসেবে চিহ্নিত করে সব ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করা হোক। একই সঙ্গে সব সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়া হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি মানবতার মা। মানবতাবিরোধী কোনো কর্মকান্ড আপনি সহ্য করেন না বলে জানি। জনগণের নেতা হিসেবে, একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আপনি পেঁয়াজ কারসাজি চক্রের হোতাদের শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনবেন, জনগণ সেটা চায়। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের সংকট জনভোগান্তি সৃষ্টি না করে তাও নিশ্চিত করতে হবে। সোহেল হায়দার চৌধুরী: বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)