শুদ্ধি অভিযান: সময়োচিত কর্মপ্রয়াস

সরকারের শুরু করা 'শুদ্ধি অভিযান'টি প্রত্যেকের মনে আবারও আশার সঞ্চার করেছে। দলমতনির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই এই অভিযান অব্যাহত থাকুক। সবার উচিত সরকারের ইতিবাচক এ কর্মে সহযোগিতা করা। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

প্রকাশ | ২০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বিমল সরকার
বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর শুরু হয় নতুন করে পথচলা। গৌরব-গরিমারই বিষয় যে, শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করলেন, এক বছর গত হতে চলেছে। টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি, আগেও ছিলেন এক মেয়াদে পাঁচ বছর (১৯৯৬-২০০১)। সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট পরিমাণেই অভিজ্ঞ শেখ হাসিনা। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কর্মস্থলে শেখ হাসিনা প্রদত্ত প্রথম বক্তৃতাটি শুনে সাধারণ মানুষ নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে। গোটা জাতির মনেই নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী 'দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদককে' প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এসবের বিরুদ্ধে তার সরকারের 'জিরো টলারেন্স' অর্থাৎ কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। বলতে বাধা নেই যে, দুর্নীতি এখন সমাজের একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। দিনে দিনে তা দূরারোগ্য ব্যাধির রূপ নেয়। তবে আশার কথা এই যে, গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ধারণা সূচকে আমাদের দেশকে দেশি-বিদেশি-আন্তর্জাতিক কোনো জরিপেই আর আগের মতো 'চ্যাম্পিয়ন' বা 'রানার্সআপ' অভিধায় অভিহিত হতে হয় না। উপরন্তু গত বছর এ ক্ষেত্রে আমাদের দুই ধাপ অগ্রগতি হয়। বঙ্গবন্ধু আজীবন অনিয়ম, অব্যবস্থা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। কিছু কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে একটুও ইতস্তত করতেন না তিনি। স্বাধীনতার পর অল্পদিনের ব্যবধানে সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মতলববাজ ও চাটুকারদের ফুলে-ফেঁপে উঠার বিষয়টি কখনো তার অজানা ছিল না। সপরিবারে তার নির্মম হত্যাকান্ডের মাত্র ২০/২৫ দিন আগে বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির অভিযোগে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীকে অপসারণ করেন। ২১ জুলাই, ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিযুক্ত ওই মন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে উলেস্নখ করেন, ''আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮(৫) ধারার আওতায় আমি আপনাকে প্রতিমন্ত্রীর পদ হইতে অপসারণ করিতেছি। এই নির্দেশ আজ হইতে কার্যকর হইবে।'' পরের দিনই তাকে কোনো কারণ না দর্শিয়ে দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় এক সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাদের নাড়ি-নক্ষত্র বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল। আর তাই জনস্বার্থে একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে তা তিনি বাস্তবায়ন করেই ছাড়তেন। এ ক্ষেত্রে কোনো চাটুকারেরই দুঃসাহস ছিল না যে, বঙ্গবন্ধুর সামনে এসে কথা বলে। ''খতিয়ে দেখতে হবে,'' ''তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে,'' ''প্রমাণিত হলে শাস্তি পেতে হবে''- এবংবিধ কথামালার সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির প্রচলন আমাদের এখানে তখনো ঘটেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই সোচ্চার। সভা-বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি দলমতনির্বিশেষে কাউকেই ছেড়ে কথা বলেননি। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিকমিডিয়ার কল্যাণে এবং তার প্রিয় দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকায় নতুন প্রজন্মের মানুষও তা সহজে জানতে পারছে। ১৫ আগস্ট সংঘটিত নৃশংস হত্যাকান্ডের একমাস আগে ১০ জুলাই, ১৯৭৫ বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে দুর্নীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ''কেবল পয়সা খাইলেই দুর্নীতি হয় না। বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করা যেমন দুর্নীতি, কাজে ফাঁকি দেওয়াও তেমনি দুর্নীতি। একইভাবে নিচের অফিসারদের কাজ না দেখাটাও দুর্নীতি।'' বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী এবং কর্মকর্তাদের যৌথ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতায় উপস্থিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ''... শুধু দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে মানুষের শতকরা ৩০ ভাগ দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হবে।'' প্রকৌশলীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ''আপনারা যদি আজকে বলেন যে, আমরা কেবল দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব, তাহলে এক বছরে বাংলার চেহারার অনেক পরিবর্তন হবে। সামান্য কিছু লোকের জন্য আপনাদের মুখ কালো হয়ে যায়। শতকরা ১০ জন, ২০ জন বা ৩০ জন যদি অন্যায় করে তাহলে একশ জনেরই বদনাম হয়। তাদের ডিসমিশ করেন না কেন? পানিশমেন্ট কেন দেন না? আমি শেখ মুজিবুর রহমান দালানের কাছে গেলে বুঝতে না পারি যে কয় বস্তা বালিতে এক বস্তা সিমেন্ট দিল। কিন্তু আপনি যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আছেন, আপনি হাত দিলেই বুঝতে পারেন, কয়টায় কয়টা দিল। কেন ধরেন না? ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। ধরতে চাইলেই ধরা যায়।'' বঙ্গবন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করে সেদিন আরো বলেন, ''বাংলাদেশের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বিদেশে গেলে সেখানে সুন্দরভাবে কাজ করে সুনাম অর্জন করে। কিন্তু দেশে ফিরে এলে কাজ করতে চায় না। কাজের মধ্যে ফাঁকি দেয়। ব্যাপারটা কী (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জুলাই, ১৯৭৫)? একজন শাসক যত সহৃদয়, সৎ, দক্ষ এবং কৌশলীই হোন না কেন, তার একার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসন করা সম্ভব নয়। প্রাচীনকালের কূটনীতিবিশারদ কৌটিল্য পন্ডিত যথার্থই বলেছেন- ?''এক চাকায় যেমন রথ চলে না, সেরূপ রাজ্য পরিচালনা রাজার একার দ্বারা সম্ভব হয় না। তার জন্য প্রয়োজন মন্ত্রী, সেনাপতি, সৈন্য-সামন্ত ও পারিষদবর্গের। সবাই মিলে রাজাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে বলেই রাজার পক্ষে সম্ভব হয় সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা করা।'' সরকারের শুরু করা 'শুদ্ধি অভিযান'টি প্রত্যেকের মনে আবারও আশার সঞ্চার করেছে। দলমতনির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই এই অভিযান অব্যাহত থাকুক। সবার উচিত সরকারের ইতিবাচক এ কর্মে সহযোগিতা করা। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। বিমল সরকার: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক নরসধষংধৎশবৎ৫৯@মসধরষ.পড়স