গুজবই এখন রাজনৈতিক দর্শন

মনে হয় রাজনীতি নেই বলেই হয়তো বিরোধী দলের কোনো মহল গুজবের রাজনীতি শুরু করেছেন। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গুজব ছড়ানো কি যৌক্তিক? সরকারকেই যখন ক্ষমতাচু্যত করা যাবে না তখন অন্তত গুজব ছড়িয়ে সরকারকে যতটা বিপর্যস্ত করা যায়।

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ডা. এস এ মালেক
পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে যে তোলপাড় হয়ে গেল তা এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। প্রতিকেজি ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ হয়েছিল ২৫০ টাকা। বাংলাদেশকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার কারণেই সম্ভবত দাম বেড়ে যায়। তবে সে দাম যে ২৫০ টাকায় উঠবে এটা কেউ কল্পনাও করেনি। ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই দেশটি বাংলাদেশে রপ্তানি বন্ধ করে। বন্ধুত্বের কারণেই কি নিজের দেশের মানুষকে না খাওয়ায়ে বন্ধু দেশের মানুষকে খাওয়াবে। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভারত বাংলাদেশের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছিল। পেঁয়াজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সুস্বাদু মসলা। এমনকি পান্তাভাত খেতেও পেঁয়াজের প্রয়োজন। তাই এর ব্যবহারও খুব বেশি। কিন্তু ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে বলে বাংলাদেশ বসে ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রথমে মিয়ানমার পরে মিশর, তুরস্ক এমনকি ভিয়েতনাম পর্যন্ত পেঁয়াজের জন্য যেতে হয়েছে। টনের পর টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। তারপরেও মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দেশব্যাপী পেঁয়াজ টিসিবি ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করেছে। এখনো করছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কার্গো বিমানে পেঁয়াজ আমদানি করার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজের দামের তারতম্য হয়নি। ঘোষণা দেওয়ার পরপরই যখন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বুঝতে পেরেছে তখন দাম কমাতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কি? মাত্র ২৫-৩০ জন দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী সমগ্র পেঁয়াজবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের গোডাউন থেকে এখন হাজার হাজার বস্তা পচা পেঁয়াজ ফেলে দিতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- পচা পেঁয়াজ এখন ফেলে দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু এই পেঁয়াজ বাজারে ছাড়া হলো না কেন? এর পেছনে কারা কি লক্ষ্যে কাজ করেছেন। শোনা যায় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা শুধু একটা মসলার দাম যদি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন এবং মাত্র কয়েকদিন তা কার্যক্রম রাখতে পারেন তাহলে কয়েকশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, বোধহয় ৯৭-৯৮ সালে হঠাৎ ধনে ও আদার দাম বেড়ে গেল। মনে হয় ৩০০ টাকার কাছাকাছি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম একমাত্র খাতুনগঞ্জের আড়তদাররাই এটা মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম গেলাম ডিসিকে দিয়ে ৩১ জন ব্যবসায়ীকে ডাকলাম। সার্কিট হাউসে কয়েক ঘণ্টা আলোচনা হলো। তারা বলল ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে। তখন আমি মজুদকৃত দ্রব্যগুলোর খতিয়ান জানতে চাইলাম। মাত্র ১৫ দিন আগে যে দ্রব্যে গুদাম পরিপূর্ণ ছিল, মাত্র ৭ দিনের ভিতর কীভাবে শেষ হয়ে গেল। আর যদি তা বাজারে সরবরাহ হয়ে থাকে তাহলে তো মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে না। ফলে আমাকে কঠোর ভাষায় কথা বলতে হয়েছিল। ঢাকায় এসে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের ডেকে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে মূল্য কমে আসে। গুদামজাত দ্রব্য হঠাৎ করে উধাও হয় কেমনে? এ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হচ্ছে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে অথবা সরকারকে বিব্রত ও বিপর্যস্ত করার জন্য। বাজারে পেঁয়াজ না থাকার জন্য যদি সরবরাহের পরিমাণ প্রয়োজনের থেকে কম হয় তাহলে দাম বেড়ে যাওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু বাজারে কমতি নেই, অথবা এমন কমতি আছে তাতে হয়তো ৫০% দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ ২৮০ টাকা পর্যন্ত দাম কারা উঠালো এর তদন্ত হওয়া দরকার। কারসাজি করে যদি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রায় যে জিনিসটি খুবই প্রয়োজন তার সংকট সৃষ্টি করে সরকারকে বিব্রত করা হয়ে থাকে, তাহলে তা কঠোর হাতে দমন করা দরকার। আর যেন ভবিষ্যতে এমন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে পেঁয়াজের দাম না কমাতেই হঠাৎ শোনা গেল লবণ নেই। লবণের দাম ৩০০ টাকা হবে। আর আপনারা সবাই দেখেছেন লবণ কেনার কি হিড়িক। সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। বলা হয়েছে এবছর লবণের বাম্পার ফলন হয়েছে, এখনো ৩ মাসের লবণ মজুদ আছে। তাহলে এই গুজব কারা সৃষ্টি করছে। পেঁয়াজের পরপরই লবণ বেছে নিল কেন? সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করতে। গুজব বলতে যা বোঝায় সত্য সত্যই এটা তা। এই সেদিন গুজব রটে গেল নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুতে নাকি শিশুদের তাজা মাথা লাগবে। কারও কারও থলিতে তাজা মাথা পাওয়াও গেল। হিড়িক পড়ে গেল ছেলে ধরার। কে কাকে ধরে- ভয়ভীতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলল। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেবতার গ্রাস কবিতায় মৈত্র মহাশয় সাগরের জলে সেই শিশুকে ফেলার ঘটনার মতো। এই বিজ্ঞানের যুগে কীভাবে ব্রিজ তৈরি হয় এবং কীভাবে তা বসানো হয় সবই তো মানুষ স্বচক্ষে দেখে। এখানে কোথায় মাথা লাগে আর তাই নিয়ে তোলপাড়। বেশ কয়েকজনের প্রাণও গেল। আমরা কোন যুগে বাস করছি। একদিকে বলছি সবকিছু ডিজিটাল হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক দেশ চলবে। অন্যদিকে সেতু বিনির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে। মানুষ আর কত পিছিয়ে যেতে পারে। কুসংস্কার মানুষকে কোথায় নিয়ে যাবে। ইতিহাসের চাকা তো পিছনে ঘোরার কথা নয়। বিগত নির্বাচনের আগে কয়েক হাজার বোরকা পরা রমণীকে গ্রামে পাঠানো হলো। তারা খুশিমতো শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে বানোয়াট গল্প বানিয়ে গ্রামের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করল। তাকে যেন ভোট দেওয়া না হয়। প্রশ্ন তোলা হয় যে মহিলা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, প্রত্যহ কোরআন তেলওয়াত করেন। এমনকি নফল রোজা রাখেন। তার বংশ পরিচয় নিয়ে কত রকমের গল্প সেখানে ছড়ানো হলো। গ্রামের নিরীহ মানুষের বিভ্রান্তি করার জন্য এই অপপ্রচার। পরে মানুষ বুঝল এই বোরকা পরা মহিলাদের কারা কি কারণে পাঠিয়েছিল। গুজবে কাজ হয়নি শেখ হাসিনার দল বিপুল ভোটে নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। এখন তো দেখা যাচ্ছে মিথ্যাচারই দলের মূল রাজনীতি। আর এরা এসব করবে না কেন। বিরোধী দলের দায়িত্বশীল নেতারা প্রকাশ্যে গুজবের চেয়েও মিথ্যা বক্তব্য রাখেন। তখন গ্রামপর্যায়ে ওসব ঘটনা ঘটবেই না কেন। বিরোধী দলের রাজনীতি প্রায় নেই বললেই চলে। খালেদা-তারেকভিত্তিক রাজনীতিতে দুর্দশাগ্রস্ত সমর্থককে এখন দল ছাড়তে শুরু করেছেন। অনেক খড়কুটা পুড়িয়ে যে রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়েছিল, তা এখন ভাঙনের পথে। এমনকি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিরোধী দলগুলো কি করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। মূল বিরোধী দলের নেত্রী দুর্নীতির দায়ে জেলে আবদ্ধ। পুত্র হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দেশত্যাগী। লন্ডনে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। দলীয় সাক্ষাৎকার এখন লন্ডনে বসেই হয়। তাদের রাজনৈতিক বিচরণ ক্ষেত্র এখন বিদেশে। লন্ডন শহরে চোর, ডাকাত, খুনি, ভালো-মন্দ সব মানুষ সেখানে থাকতে পারে। লন্ডন দেশদ্রোহীদের একটা নিরাপদ আশ্রয় স্থল। ব্রিটেন নাকি খুব সভ্য ও মানবিক। তাই এই অবস্থা। মনে হয় রাজনীতি নেই বলেই হয়তো বিরোধী দলের কোনো মহল গুজবের রাজনীতি শুরু করেছেন। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গুজব ছড়ানো কি যৌক্তিক? সরকারকেই যখন ক্ষমতাচু্যত করা যাবে না তখন অন্তত গুজব ছড়িয়ে সরকারকে যতটা বিপর্যস্ত করা যায়। ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক