সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তাতে নিরাপদ সড়ক বলে কিছু নেই। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। মনে রাখতে হবে বড় বড় দুর্ঘটনা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে না পারি তবে ভবিষ্যতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। দুর্ঘটনায় মৃতু্যর হার কমাতে হলে দোষীদের তাৎক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণকেও নৌ, রেল ও সড়ক পথে ভ্রমণ ও রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে। পরিকল্পিত ও সফল উদ্যোগই কেবল পারে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধ করতে।

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
দেশে যাতায়াতজনিত দুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর বিভীষিকা থেকে কিছুতেই যেন রক্ষা নেই এ দেশের মানুষের। কিন্তু ভয়াবহ এ দুর্ঘটনাগুলো কেন হচ্ছে কারা এর জন্য দায়ী তা শনাক্ত করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ ও তৎপরতা চোখে পড়ছে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণেই এর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার কারণেই এ দেশের মানুষ আপনজন হারিয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছে আর নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য পরিবার। অথচ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মূলত অবৈধ চালক ও চালকের অসতর্কতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও খামখেয়ালিপনা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও সড়ক-মহাসড়কের ভঙ্গুর অবস্থা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে সরকার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তেমন ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলায় দুই চালক ও এক সহকারীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রোববার বিকেলে আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। দুই বাসের রেষারেষির মধ্যে চাপা পড়ে রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃতু্যর ঘটনায় যাবজ্জীবনের রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহত ছাত্রী দিয়া আক্তার মিমের পরিবার। আদালতের যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত জাবালে নূরের চালক মাসুম বিলস্নাহর ফাঁসির চেয়ে উচ্চ আদালতে যেতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি তারা দাবি জানিয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, সড়ক আইন জনগণের নিরাপত্তার আইন। জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকার আপস করবে না। এ আইন সবার জন্য। এটি নিয়ে সরকার আপস করবে না। রাস্তায় নৈরাজ্য চলতে দেওয়া যাবে না। মন্ত্রীর কথায় আমরা আশাবাদী হতে পারি। বাসচালক ও চালকের সহকারীদের খামখেয়ালির কারণে নিরীহ ছাত্রছাত্রীসহ যাত্রীরা প্রাণ হারাচ্ছেন। তাদের কবল থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। চালকদের আরও সতর্ক হতে হবে। একই সঙ্গে চালকরা কোনোভাবেই যাতে হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নিয়ে ভারী যানবাহন চালাতে না পারেন, সে ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশদের আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল হতে বলেছে আদালত। আদালতের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করছি। রাজধানীতে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারানোর পর রাজীবের মৃতু্যর ঘটনা এখনো মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। এরই মধ্যে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে। বেপরোয়া গতির একটি বাসের সঙ্গে অন্য একটি বাসের ধাক্কায় ফিরোজ সরদার (২৫) নামের এক কলেজ ছাত্রের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফিরোজ রাজশাহী কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে একের পর এক এই ধরনের ঘটনা কি ঘটতেই থাকবে। এর কি কোনো প্রতিকার নেই। রাজীবের হাত হারানোর পর আমরা ভেবেছিলাম সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু কোনো আন্দোলন প্রচেষ্টাই কাজে আসছে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর দেশের সচেতন জনসাধারণ ভেবেছিল, পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই সড়কে প্রাণ ঝরছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ হয়েছে। এখনো সেভাবে কার্যকর হয়নি পরিবহণ শ্রমিকদের বাধার মুখে। সঙ্গতকারণেই ঢাকার সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা। সড়কে শৃঙ্খলা না থাকায় হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কে লেন মেনে গাড়ি চালানোর দৃশ্য নেই, আছে শুধু প্রতিযোগিতা করে গণপরিবহণ তথা বাস চালানোর দৃশ্য। সেই সঙ্গে সড়কের মাঝখানে যাত্রী ওঠানামাও বন্ধ হয়নি। উলেস্নখ্য, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই পালস্না দিয়ে বাস চালাতে গিয়ে বিমানবন্দর সড়কে নির্মমভাবে এই দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা করে জাবালে নূর পরিবহণের চালক। বাসচাপায় শিক্ষার্থীদের এ হতাহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে ওইদিনই রাস্তায় নামেন রমিজউদ্দিনসহ আশপাশের কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের ঢেউ। সারা দেশের রাস্তায় নামেন লাখো লাখো শিক্ষার্থী। সেখান থেকে সূত্রপাত হয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের। \হঅন্য এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত ১৫ বছরে সড়ক পথে ৫৫ হাজার মানুষের মৃতু্য হয়েছে। ৭০ হাজার মামলাও হয়েছে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়। অন্যদিকে রাজধানীতে বছরে ১৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনায়। ৩ বছরে ৬ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন রাজধানীতে। মানুষের জীবন যে কত তুচ্ছ তা এসব ঘটনার দ্বারা আবারও প্রমাণিত হলো। চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, দৈনিক চুক্তিতে চালক, কন্ডাক্টর বা হেলপারের কাছে গাড়ি ভাড়া দেওয়া, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, সড়কে চলাচলে পথচারীদের অসতর্কতাসহ ১০টি কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। যোগ্য ও দক্ষ লোকেরাই যেন গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পায় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিআরটিএর। যদি যোগ্য লোককে লাইসেন্স দেয়া হয় তা হলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। এ ছাড়া চালকের বিশ্রামের বিষয়টিও ইদানীং আলোচনায় উঠে এসেছে। ঘুমহীনভাবে গাড়ি চালাতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। শিক্ষিত ও সচেতন চালক নিয়োগ দেয়াও জরুরি। সড়কের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে বিআরটিএ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছয়টি সেশনে ২০০ গাড়িচালককে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এ ছাড়া বিআরটিএ কর্তৃক ইসু্যকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, রুটপারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট ইত্যাদি কাগজপত্রাদির সঠিকতা যাচাই কৌশল, সরেজমিন ইসু্যর পদ্ধতি এবং মোটরযান আইন ও বিধি সম্পর্কে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিআরটিএ থেকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে ২০০ জন ট্রাফিক পুলিশ এবং ২০১৯ সালে ২৫০ ট্রাফিক পুলিশকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ২০১১-২০ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০-এর অনুসমর্থনকারী হিসাবে গোল - ৩.৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ লক্ষ্যে বিআরটিএ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংস্থাটি চলতি বছর দক্ষ চালক তৈরির জন্য ১ লাখ ২ হাজার ১৭৯ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের গণসচতেনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রচারাভিযান চালাচ্ছে বিআরটিএ। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর এবং পাস হওয়ার আগে থেকেই 'নতুন নিরাপদ সড়ক আইন' সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয় বিআরটিএ। এই সব উদ্যোগ ও তৎপরতার ফলে দুর্ঘটনা কমাসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তাতে নিরাপদ সড়ক বলে কিছু নেই। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। মনে রাখতে হবে বড় বড় দুর্ঘটনা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে না পারি তবে ভবিষ্যতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। দুর্ঘটনায় মৃতু্যর হার কমাতে হলে দোষীদের তাৎক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণকেও নৌ, রেল ও সড়ক পথে ভ্রমণ ও রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে। পরিকল্পিত ও সফল উদ্যোগই কেবল পারে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধ করতে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক