বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জন

প্রতিবিপস্নবের শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তিনি যেভাবে দেশকে দ্রম্নত এগিয়ে নিচ্ছেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে এ দেশ কখনো আর স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মূল্যবোধ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। স্বাধীনতার লক্ষ্য ও এর সুফল প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক, সেই প্রত্যাশা করি। আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী সব বীরশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ডা. এস এ মালেক
যে অর্থে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই অর্থে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কোনো দিনই স্বাধীন ছিল না। অতীতে যারা এ দেশ শাসন করেছেন, তারা প্রায় স্বাধীনতার কাছে পৌঁছে গেলেও সর্বাত্মক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারেননি। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্র কাননে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, তা ১৯৭১ সালে বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলার আম্র কাননে আবার উদিত হয়েছিল বলে দাবি করা যায়, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক। এই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী যারা ধর্মীয় পরিচিতিতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে অভিহিত, তারা জাতিসত্তা হিসেবে বাঙালিত্বকে বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন। ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার ঐতিহ্যভিত্তিক জাতিসত্তায় বাঙালির গৌরব। ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কার এই জাতিসত্তাকে মাঝেমধ্যে বিপন্ন করতে সক্ষম হলেও, এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাঙালি জাতিসত্তা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েও বাঙালিত্ববোধ বজায় রেখেছে। পাকিস্তানের ধর্মীয় ও সাম্প্রাদায়িক জাতীয়তাবাদ তা বিনষ্ট করতে পারেনি। সুপ্ত এই জাতীয়তাবাদ শক্তিই আমাদের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই আমরা গর্বিত আমরা বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ। বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালিয়ে এবং শুধু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রবর্তন করে বাঙালির চিন্তা ও চেতনায় পাকিস্তানের কাছে বাঙালিত্ব হারিয়ে যাবে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে যখনই উর্দুকে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলেন, তখনই বাংলার দামাল ছেলেরা তা বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করল। নো নো বলে চিৎকার করে উঠল। আর এই নো একদিন শুধু উর্দুকে নয়, পাকিন্তানকেও নো বলে দিল। তাই আমরা আজ স্বাধীন। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যেসব মানুষ রক্ত দিয়েছেন, তারা ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। ভাষা আন্দোলনে বিজয়ী হয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই আন্দোলনে ভাষাসৈনিক হিসেবে প্রাণ দিয়েছেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক ভাষা শহীদ, তারাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা। জাতি তাদের আত্মত্যাগ কোনো দিন ভুলবে না। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল ১২০০ মাইল দূরে ভৌগোলিক অবস্থানরত কারণে একটা ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কখনো তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে না এবং কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব-বাংলার অবাধে সম্পদ লুণ্ঠন করে পাকিস্তানকে সমৃদ্ধশালী করে তুলবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই বাঙালি কিন্তু তাদের অপকৌশল বুঝতে পারে এবং পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। আর এই দাবিতে যিনি তার ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জন করেন, তিনি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু। তিনি বুঝেছিলেন কোনো ভেক কথাবার্তা নয়, সুনির্দিষ্ট ভাষা ও দাবিতে পূর্ব-বাংলায় পরিচালিত নির্মম শোষণের অবসানকল্পে, সম্পদের পাচার বন্ধ করে চিরদিনের জন্য পাকিস্তানের শাসনের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে হবে। তাই ৬ দফাকেই স্বায়ত্তশাসনের বস্তুনিষ্ট দাবি বলে অভিহিত করা যায়। এই ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পূর্ব-বাংলার জনগণকে পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদমুখী জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করলেন, যা তাকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনে সক্ষম করে। বস্তুত ৭০-এর নির্বাচন ৬ দফাকে জনগণ মেনডেট প্রদান করে। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাকে পূর্ব-বাংলার একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রায় দুই দশক ধরে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির মহান মুক্তি সংগ্রামে যে অবদান রেখেছিলেন, তারই প্রতিদান পেলেন ১৯৬৯-এর সফল গণঅভু্যত্থানের মাধ্যমে। ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। এরপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলার মানুষ মেনে চলেছে। পাকিস্তানি শাসকরা যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার কাছে ক্ষমতা দিল না, ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন, তখন তিনি এর প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। আর এই অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনিই প্রমাণ করলেন, পূর্ব-পাকিস্তান শাসন করার অধিকার পাকিস্তান সরকারের নেই। তিনি পূর্ব-বাংলার প্রকৃত শাসক। তা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। একটা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই আন্দোলন-সংগ্রামের নেতা সেই দেশ শাসন করেন, এমন দৃষ্টান্ত আর আছে বলে মনে হয় না। বস্তুত ৩ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পূর্ব-বাংলা শাসিত হয়েছে। ঢাকা সেনানিবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। পূর্ব-বাংলার জনগণ শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনেছে, পাকিস্তান সরকারকে অগ্রাহ্য করেছে। গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব বলেছিলেন, 'তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না, বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান'। ৬ দফা জনগণের ম্যানডেটের পরিবর্তন করার ক্ষমতা জনগণ তাকে দেয়নি। এর পরই পাকিস্তান সামগ্রিক যুদ্ধের প্রস্তুতি ও ২৫ মার্চ কালো রাতে সার্চ লাইটের মাধ্যমে আগ্রাসন শুরু করে। এক রাতেই ২৫ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। আক্রমণ চালায় পিলখানা, পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও জনবসতিতে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নির্দেশ দেন বাংলার মাটি থেকে একজন দখলদার সৈন্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। পাকিস্তানি শাসকরা তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে আটক রাখে। ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ দেয় এবং সমাহিত করার জন্য কবর পর্যন্ত খুঁড়ে রেখে তারা অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ও আত্মসমর্পণের পর সম্পূর্ণ এক ঐতিহাসিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে আসে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধী এ ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিজ্ঞা করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি না দিলে তারা পাকিস্তান সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধ করবে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে জনগণের উদ্দেশ্য ভাষণ দেন, তা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের স্বাধীনতা জাতি হিসেবে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭৫-এর প্রতি বিপস্নবের পর যারা এই মহান স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলেছিল, তারা কিন্তু আজও পরাজয় মেনে নেননি। ৭৫-এর প্রতিবিপস্নবের ধারায় তারা বারবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে চলেছে। এই প্রতি বিপস্নবের কারণে যে মূল্যবোধগুলো বিসর্জিত হয়েছিল, দেশরত্ন শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার কারণে তা একে একে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এখনো বিপর্যয়মুক্ত নয়। স্বাধীনতার শত্রম্নরা এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে আঘাত হেনে চলেছে। লক্ষ্য একটাই মহান স্বাধীনতাকে অর্থহীন করা। এ দেশে আবার সাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক মৌলবাদের রাজনীতি প্রবর্তন করা। বঙ্গবন্ধু তন্ময়া জননেত্রী শেখ হাসিনা এসব হিসাব-নিকাশ বুঝেই রাজনীতি করছেন। তার কৌশলগত কারণে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে কেউ কেউ কিছু সন্দিহান হলেও মূল লক্ষ্য অর্জনে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ ব্যাপারে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রতিবিপস্নবের শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তিনি যেভাবে দেশকে দ্রম্নত এগিয়ে নিচ্ছেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে এ দেশ কখনো আর স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মূল্যবোধ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। স্বাধীনতার লক্ষ্য ও এর সুফল প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক, সেই প্রত্যাশা করি। আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী সব বীরশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক