নেশার ছোবলে তরুণ সমাজ

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শাহজাহান আবদালী শিশুসাহিত্যিক রম্যলেখক ঢাকা
যে জিনিস সেবন করলে কিংবা বাহ্যিকভাবে শরীরে গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক আচরণসহ অচেতন হয়ে নিজের ক্ষতি এবং অন্যের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না তাকেই নেশা বলে। নেশা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য নেশা হচ্ছে- মদ, গাঁজা, চরস, আফিম, ইয়াবা ও তামাকজাতীয় দ্রব্যাদি। আচরণগত নেশা বলতে বোঝায় জুয়া খেলা, তাস খেলা, আড্ডা মারা, মারামারি করা, বিনা স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে হেরোইন ও প্যাথিডিন শরীরে গ্রহণ করা। কোনো নেশাই নিজের পরিবারসহ অন্যের মঙ্গলদায়ক নয়। নেশা আসক্ত মানুষ কমবেশি চিরকালই ছিল। বর্তমানে এর ভয়াবহতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নেশাগ্রস্ত মানুষ কেন বাড়ছে এর কারণ খুঁজলে বের হয়ে আসবে, দেশে ব্যাপক বেকার সমস্যা। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা নেশাগ্রস্ত বেশি হচ্ছে। গ্রাম থেকে আসা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিব ঘরের সন্তানরা বাবা-মায়ের জমিজমা, ভিটে-মাটি বিক্রি করে শহরে এসে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে কোনো চাকরি পায় না। বর্তমানে অফিসার পদে চাকরি পেতে হলে ১০-২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো কোনো চাকরির ক্ষেত্রে ৩০-৪০ লাখ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। এত টাকা পাবে কোথায়? এছাড়া কেউ কেউ উলিস্নখিত টাকা দেওয়ার পর চাকরি এবং টাকা দুটোই হাতছাড়া হয়ে যায়। মধ্যভোগী হিসেবে যারা এ ধরনের টাকা গ্রহণ করে তারা রাজনৈতিকভাবে কিংবা বিভিন্ন কারণে ওদের ক্ষমতার অবস্থান থাকে অনেক উঁচুতে। ইচ্ছে করলেই হুমকি-ধমকি দিয়ে সেই টাকা আদায় করতে পারে না। ফলে চাকরির প্রার্থীরা হতে হয় পথের ভিখেরি। বাবা-মায়ের জমিজমা বিক্রি করে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। সেই সঙ্গে হাওলাত-কর্জ করে লাখ লাখ টাকা প্রতারককে দিয়েছে। কী করবে? কোথায় যাবে? আত্মহত্যা করা মহাপাপ। বাধ্য হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনে কত না স্বপ্ন দেখেছিল, ভবিষ্যতেই এই হবে, সেই হবে। কিন্তু উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পর সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পরিবারে ও সমাজে তারা হয়ে যায় অবহেলার পাত্র। এত বড় ডিগ্রি নিয়ে যেমন-তেমন চাকরি করতে বিবেকে বাধা দেয়। বেসকারি প্রতিষ্ঠানে মাসে যে টাকা বেতন পাবে, সেই টাকা শেষ হয়ে যায় মোবাইল ও ইন্টারনেট চালাতে গিয়ে। পুরো জীবনটা বৃথা। উন্নতমানের পোশাক-আশাক না পরতে পারলে সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য থাকে না। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে কতদিন চলা যায়? বেকার ছেলেকে হাত খরচের টাকা দেবে, সেই সামর্থ্য অনেক পরিবারের নেই। ফলে এসব ছেলেরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দলবদ্ধ হয়ে নেশা না করলে কি চলে? অল্পদিনের মধ্যে নেশাগ্রস্ত অনেক বন্ধু জুটে যায়। নেশার টাকা জোগাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে অবৈধ কর্মকান্ডে। তখন তাদের নীতি-আদর্শ বলতে কিছু থাকে না। দল ত্যাগ করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়তে দ্বিধা করে না। নিজে নেশা করে এবং নেশাখোর নেতার পেছনে ঘোরে। একে ধরে, তাকে মারে, এই হলো তাদের কর্মসূচি। সরকার দলীয় কর্মী হিসেবে একটু-আধটু সম্মানও পায়। নিরীহ জনগণ ভয়ে তাদের সালাম দেয়। যতদিন দল ক্ষমতায় থাকে ততদিন ভালোই কাটে তাদের দিনকাল। দল ক্ষমতা হারালে তাদের জেল-হাজত খাটতে হয়। তাদের প্রধান আয়ের উৎস থাকে বিচার-সালিশ। বর্তমানে এটিকে বলা হয় ফিটিং ব্যবসা। নিরীহ মানুষকে ডেকে এনে বিনা কারণে অপরাধী বানিয়ে টাকা আদায় করাই এই ব্যবসার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিচার-সালিশে যাওয়ার আগে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়. এত টাকা দিতে হবে। বিচারের ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না। টাকা দিলেই জিতিয়ে দেয়। এসব সালিশিতে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কোনো মূল্যায়ন নেই। রাজ্য তাদের। রাজাও তারা। বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসা গ্রামগঞ্জে বেশ রমরমা। বিরক্ত না করার জন্য এলাকার ক্ষমতাশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে কোনো কোনো ইউপির চেয়ারম্যান এবং থানাতে ব্যবসার অংশ হিসেবে মাসিক ফি দিতে হয়। গ্রামের জ্ঞানী-গুণীরা বাধা দিলে অপমানিত হতে হয়। অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নেশা নিরাময় আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে ভর্তি হলে প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। নেশা করার আগে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা না করে অতিমাত্রায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে নিরাময় আশ্রয় চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে এ দেশে। এসব উচ্চ শিক্ষিত নেশাগ্রস্ত ছেলেদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়ে উচ্চশিক্ষিত দেখে মেয়ে বিয়ে দিয়ে প্রথমে দম্ভ আর অহংকারের শেষ নেই। আত্মীয়-স্বজনসহ পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে শুধু একই কথা- জামাই বাংলাদেশের পড়ালেখা শেষ করে ফেলেছে। একাধিক ডিগ্রি নিলে দেশের বাইরে যেতে পারবে। শত হলেও উচ্চশিক্ষিত জামাই, লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। দামি ফার্নিচার না দিলে মান-সম্মান থাকে না। শিক্ষিত জামাই হিসেবে ঈদে দামি পোশাক-আশাক দিতেই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই মেয়েকে পিটিয়ে পাঠায় বাপের বাড়িতে টাকা আনার জন্য। মেয়ে শুধু চোখের পানি ফেলে। ক্রমান্বয়ে জানতে পারে জামাই বাবা নেশা করে। শ্বশুরবাড়ি, নিজের পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনকে অশান্তিতে রাখার জন্য একজন নেশাখোরই যথেষ্ট।