খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। সারা বিশ্বে যেখানে ঋণখেলাপি কমছে, সেখানে বাংলাদেশে এই চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগের বলেই মনে করেন আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা। আবার, আর্থিক খাতে ঋণের সুদহার বেশি হওয়ার পেছনেও খেলাপি ঋণের ভূমিকা বেশি বলে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক তথ্যে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে চিত্র প্রকাশ করে, প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরই লুকিয়ে রাখে বলেও মন্তব্য করেছে আইএমএফের আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা। খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখার কারণে ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। সার্বিকভাবে এ বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের বলেই প্রতীয়মান হয়। তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থা (আইএমএফ) ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত পর্যালোচনা করে গত অক্টোবরে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে সংস্থাটি ৪৩টি সুপারিশ করে। ওই প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংক খাতের নানা অব্যবস্থা ও সংকটের খোলামেলা আলোচনা করা হয়। সেখানে খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের ভয়াবহ একটি চিত্রও তুলে ধরে আইএমএফ। বলার অপেক্ষা রাখে না, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়টি আলোচনায় আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী, আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ৪ দশমিক ১ শতাংশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাব বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে রাখা ঋণ এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে দেয়া অনাপত্তি সার্টিফিকেট (এনওসি) প্রদানের মাধ্যমে দেয়া ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত প্রকৃত ঋণখেলাপির চিত্র বুঝতে। আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী, এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি এখন প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র সামনে আনার বিষয়টিকেই চালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। প্রসঙ্গত উলেস্নখ করা যেতে পারে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের এ চিত্র বাস্তবিকই উদ্বেগজনক। প্রশ্ন ওঠে, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কি কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়? বস্তুত, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ক্রমাগত উলস্নম্ফন দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত। এর আগে জানা গিয়েছিল, বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশই খেলাপি। অথচ আন্তর্জাতিক মানদন্ডে ২ থেকে ৩ শতাংশ খেলাপি ঋণকে সহনীয় বলে ধরা হয়ে থাকে। এর বেশি থাকলেই তা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। আর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ হলে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে আমরা কোন অবস্থানে আছি তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে এ অবস্থার অবসানই কাম্য। আমরা জানি, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা, এ টাকা নিলে ফেরত দিতে হবে। সরকারি বা বেসরকারি যে ব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া হোক না কেন, ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য যথার্থ হলেও ঋণ পরিশোধে আশা জাগানিয়া তেমন কোনো তথ্য নেই। এমনকি নানা প্রণোদনা দিলেও এ ক্ষেত্রে দৃশমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া মানেই এক ধরনের নতজানু নীতির বহির্প্রকাশ। বলাই বাহুল্য, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ। বস্তুত খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়- দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ঝুঁকি তৈরি করছে। সঙ্গত কারণেই, উচ্চ খেলাপি ঋণ কমাতে এবং প্রকৃত ঋণের তথ্য সামনে আনতে আইএমএফের পরামর্শগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন আবশ্যক। সর্বোপরি বলতে চাই, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির প্রভাবে এগোতে পারছেন না ভালো উদ্যোক্তারা। ফলে বাড়ছে না বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। আর এ থেকে বের হতে হলে, কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয় এটাও সত্য। এ জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনের এসংক্রান্ত আইনের সংশোধন। আইএমএফের সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা প্রতিবন্ধতাগুলো নিরসনের যথাযথ উদ্যোগ নিক- এটাই প্রত্যাশা।