বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতেই হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের

একাত্তরের ঘাতকদের যেমন ঘৃণা করতে হবে, তেমনি সচেতনভাবে বর্জন করতে হবে তাদের প্রগতিবিরোধী চিন্তাচেতনাকেও। তাহলেই কেবল আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কে এম মাসুদুর রহমান
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা ষড়যন্ত্র ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। ৯ মাস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও খুনিরা যখন বুঝে যায় পরাজয় আসন্ন তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধা ও মননে পঙ্গু করে দেওয়ার শেষ অপচেষ্টায় নামে। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের ওপর। আর এ কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি নির্মমতার পরিচয় দেয় রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের মাত্র একদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে ব্যাপকসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। বাংলাদেশের মানুষ যাতে স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এ হত্যাকান্ডে অংশ নেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবী দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র)। ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)। ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)। ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য)। ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস)। ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য)। ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা)। ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা)। হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য)। রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য)। সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা)। ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান)। এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান)। এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা)। শরাফত আলী (গণিত)। এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা)। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা)। এম এ সাদেক (শিক্ষা)। এম সাদত আলী (শিক্ষা)। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস)। গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস)। রাশীদুল হাসান (ইংরেজি)। এম মর্তুজা (চিকিৎসক)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : ড. হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ)। ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত)। মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)। চিকিৎসক : অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ)। অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)। অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ। অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী। ডা. হুমায়ুন কবীর। ডা. আজহারুল হক। ডা. সোলায়মান খান। ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী। ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার। ডা. মনসুর আলী। ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা। ডা. মফিজউদ্দীন খান। ডা. জাহাঙ্গীর। ডা. নুরুল ইমাম। ডা. এস কে লালা। ডা. হেমচন্দ্র বসাক। ডা. ওবায়দুল হক। ডা. আসাদুল হক। ডা. মোসাব্বের আহমেদ। ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)। অন্যান্য : শহীদুলস্নাহ কায়সার (সাংবাদিক)। নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক)। সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক) সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক)। আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক)। আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার)। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ)। রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর)। যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)। জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার)। মেহেরুন্নেসা (কবি)। ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ)। নজমুল হক সরকার (আইনজীবী)। নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)সহ নাম জানা-অজানা অনেকে। বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিম্নরূপ: শিক্ষাবিদ- ৯৯১ জন। সাংবাদিক-১৩। চিকিৎসক-৪৯। আইনজীবী-৪২। অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী)-১৬। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেণ্য হাজার হাজার শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর চালায় নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন তারপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। তারা আরও মনে করেছিল, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গুত্ব করতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকান্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। বর্বর পাক বাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। স্বাধীনতাযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস ধরেই চলেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের বর্বর হত্যাকান্ড। নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। তার পরও যখন তাদের শেষরক্ষা হলো না, বাংলার দামাল ছেলেদের অব্যাহত পাল্টা আক্রমণে দিশাহারা, মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যখন আসন্ন, তখনই পাকিস্তানি বাহিনী মরণকামড় হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণিত প্রয়াস নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের ওপর। আর এই কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। তারাই বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে আনে এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এই বুদ্ধিজীবীরা বাঙালির বিকাশে নব্য পাকিস্তানের অসারত্ব তুলে ধরেছিলেন। পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও শোষণের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। তারা এমন একটি সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যা পরাধীনতার অন্ধকার থেকে দেশকে নিয়ে যাবে আলোর ভুবনে। এ কারণেই তারা ঘাতকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম আর বিজয় অর্জনের পথে তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। যে চেতনার জগৎ তারা গড়ে তুলেছিলেন, সেই চেতনা থেকেই আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। পরিশেষে বলছি, বুদ্ধিজীবী দিবস পালন সবচেয়ে সার্থক হবে তখনই, যদি আমরা সেই চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করি এবং সেই চেতনার যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করে যাই। স্বাধীনতাবিরোধীরা নানা কৌশলে সেই চেতনার জগতে আঘাত হানতে চাইবে, কিন্তু চেতনা রক্ষায় আমাদের সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একাত্তরের ঘাতকদের যেমন ঘৃণা করতে হবে, তেমনি সচেতনভাবে বর্জন করতে হবে তাদের প্রগতিবিরোধী চিন্তাচেতনাকেও। তাহলেই কেবল আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। কে এম মাসুদুর রহমান: রাজনীতিক ও কলাম লেখক