বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও বিশ্বাসঘাতকের পুনরুত্থান

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ফরহাদ আলী সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উদারনৈতিক আদর্শের ধারক। যেটির প্রতিফলন বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনে আমরা বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বভাবসুলভ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি সাধারণ মানুষের কাছে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনকে করেছিল আরও উজ্জ্বলতর। কিন্তু ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দি এবং তাদের এদেশীয় দোসর চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তাদের বিনা বিচারে ক্ষমা প্রদর্শন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির ভ্রম বলে অনেকে মনে করলেও বাস্তব পরিস্থিতিকে তিনি যে অস্বীকার করতে পারেননি সেটিই ধরে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি উপদলীয় কোন্দলের মূল হোতা খোন্দকার মোশতাক, মাহবুব আলম চাষী এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো বিশ্বাসঘাতকদেরও বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করে দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা অর্জনের পর পরাজিত যুদ্ধাপরাধীদের এমন ঢালাওভাবে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছিল। একমাত্র বাংলাদেশেই সেটা করেছিলেন উদারতার মহান প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, দেশের মঙ্গলের স্বার্থে তিনি যাদের সেদিন ক্ষমা করে নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলেন পরে তাদেরই করা ষড়যন্ত্রের ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই প্রশস্ত বুক বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারের সেই বাড়িটি দেখতে পেয়েছিল বিশ্বাঘাতকের উলস্নাস মাখা অট্টহাসি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় খোন্দকার মোশতাককে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তখন শুধু ক্ষমতার লোভে দলের সঙ্গে বেইমানি করে মোশতাক আওয়ামী মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে শেরে-বাংলার কৃষক-প্রজাপার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ঠিক তার ১০ বছর পর বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করে দিয়ে আওয়ামী লীগে পদ দেন। কিন্তু তিনি পরে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং পরবর্তী সব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করার প্রচেষ্টা করেছিলেন যদিও বারবারই ব্যর্থ হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন খোন্দকার মোশতাক। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তার গোপন আঁতাত তখনও ছিল অব্যাহত। তিনি কখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। শুধু ঈর্ষার তাড়নায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন তার কাছে ছিল গায়ে কাঁটা ফোটার মতো। এই খোন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের মধ্যে খুব চাতুর্যের সঙ্গে একটি প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থি উপদল সৃষ্টি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। সঙ্গে নেন তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষী এবং তথ্য ও বেতারমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরকে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার স্বাদ পেতে যাবে, একের পর এক বিজয় নিশ্চিত করে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা, তখনই তারা গোপনে বেশ কয়েকবার আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে। যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত জেনে দুই দেশের মধ্যকার চলমান যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন যাতে পাকিস্তানের ভাঙন আপাতত রোধ করা যায়। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন, তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুকে মৃতু্যর মুখে ঠেলে দিয়েও যুদ্ধ চালানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। তারা প্রচারপত্র বিলি করে মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের জনগণকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন, 'তারা স্বাধীনতা চায় নাকি বঙ্গবন্ধুকে চায়?'। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং তাজউদ্দীনের প্রতি মানুষের একপ্রকার ক্ষোভও সৃষ্টি হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের পরীক্ষিত সৈনিক দৃঢ়চেতা তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বন্ধের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও বিষয়টি উত্থাপন করার নীল নকশা প্রস্তুত করেন বিশ্বাসঘাতক মোশতাকচক্র। সৌভাগ্যক্রমে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বুঝতে পারেন। পরে তিনি মোশতাকের পরিবর্তে বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে জাতিসংঘে প্রেরিত কমিটির প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন। এতে মোশতাক তাজউদ্দীনের প্রতি ক্ষুব্ধ হলেও তখন প্রকাশ করার সাহস দেখাননি। শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে সবকিছু শুনেও মোশতাক এবং তার সহচরদের ক্ষমা করে দেন। শুধু ক্ষমা করেই শেষ নয় তিনি আবার তাকে নিজের দলেও টেনে নিলেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করার জন্য চীন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন না হলে এই দুই দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা ছিল না সেটা বঙ্গবন্ধু খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু প্রথমে নিতান্ত গুরুতর অপরাধীদের ছাড়া পাকিস্তানের ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দিকে এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দক্ষিণপন্থিরা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী সব উচ্চপদের কর্মকর্তাদের স্বপদে বহাল এবং সিনিয়রিটি ধরে রেখে প্রমোশন দেয়ার জন্য ওকালতি শুরু করেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে এটা বোঝান, দেশ পুনর্গঠন করতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা ছাড়া ভালো সাফল্য আসবে না। এভাবে প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকদের অবস্থান শক্ত ভিত্তি পায়। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সম্পর্ক অবনতির পেছনেও রয়েছে মোশতাকচক্রের বিষদগার। যার মাধ্যমে খোন্দকার মোশতাক তার পুরনো অপমানের প্রতিশোধ খুব ভালোভাবেই নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপ, দেশের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা এবং দেশীয় বাম চরমপন্থিদের উত্থান রোধ এবং দেশ পুনর্গঠনে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করলেন। তাই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি 'বাকশাল' গঠনের মাধ্যমে বামপন্থি আদর্শিক একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধান সংশোধন করেন এবং নিজের সারা জীবনের কষ্টের ফসল, গণতন্ত্রের পতাকাবাহী, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘোষণা করলেন। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন সেটা হলো, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে সারাজীবন গণতন্ত্রের চর্চা করা, উপমহাদেশের প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অন্যতম একটির প্রধান হয়েও বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়েছিলেন সাময়িক সময়ের জন্য বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বদলে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য। আশ্চর্যের বিষয় তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকা মানুষ কেউ এর বিরোধিতা করেননি। তারা দলে দলে গিয়ে বাকশালে যোগদান, বঙ্গবন্ধুকে শুভচ্ছা, শুভকামনা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরাও বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু এর মধ্য থেকেই আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থিচক্র বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল। ক্ষমতা লোভী বিশ্বাসঘাতক মোশতাকচক্র আঁতাত গড়ে তোলে সামরিক বাহিনীর বিপথগামী সদস্য ফারুক, রশিদ, নূরদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গের এদের রাজনৈতিক কোনো বিরোধ না থাকলেও ব্যক্তিগত কিছু আক্রোশ ছিল। ১৫ আগস্ট প্রতু্যষে বিশ্বের ইতিহাসে ঘটল এমন এক ঘটনা যা বিশ্বের ইতিহাসে নজির হয়ে থাকল। বাংলাদেশের স্থপতি সপরিবারে নিহত হলেন তারই এনে দেয়া স্বাধীন দেশের কিছু মানুষের হাতে যাদের তিনি সব সময় কাছেই রেখেছিলেন। নেপথ্যে ভূমিকা রাখলেন এ দেশের সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে দক্ষিণপন্থি ক্ষমাপ্রাপ্ত কিছু আমলা এবং সাংবাদিকরা। বিদেশি শক্তি হিসেবে এদের সার্বক্ষণিক মদদ জুগিয়েছিলেন আমেরিকা ও পাকিস্থান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতার মসনদে বসলেন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় বারবার ক্ষমা পাওয়া সেই খোন্দকার মোশতাক। শুরু হলো বিশ্বাসঘাতকের পুনরুত্থান।