শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বছরে নতুন আশাবাদ

কামাল লোহানী
  ০১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের একটি বছর পেরিয়ে ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি যাত্রা শুরু করলাম নতুনের পথে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এই একটি বছর আমাদের অনেক প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবে; কিন্তু কতটা হবে তা গবেষক ও পন্ডিতজনরা নির্ণয় করবেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাঙালি আদিবাসী সবাই মিলে যা কিছু পেতে চেয়েছিলাম বিগত একটি বছরের প্রচলিত রীতি অনুসারে, আজ তারই প্রশ্ন তুলছি, পেরেছি কী তা পূর্ণ করতে? তবে হঁ্যা একথা তো বলতেই পারি, সরকারের যে প্রগতির হিসেব তা হয়তো অনেকটাই দৃশ্যমান এবং এই দেশের নাগরিক হিসেবে সে জন্য নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞ থাকার কথা চলতি সরকারের কাছে। পারছি কি তা? অবকাঠামোগত উন্নয়নের বহুল প্রচার আমাদের চোখকে ঝাপসা করে দিচ্ছে; কিন্তু সেই অর্ধমগ্ন চোখে আমরা যে দেখতে পাচ্ছি মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ছে। এত অনস্বীকার্য সরকার যারা পরিচালনা করে, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই থাকে দেশের সমৃদ্ধির দিকে। নিমগ্নচিত্তে পরিকল্পিত কর্মসূচির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় বাস্তবায়িত কর্মের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে আদৌ কী ভাবী? প্রবৃদ্ধির উন্নতির হারের কামনায় আমরা এতটাই ব্যস্ততায় দিনাতিপাত করি যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এর কী কোনো গতি সঞ্চার করতে পেরেছে, তা ভাবার হয়তো সময় পাই না। বছরটা উন্নতির এ কথা অনস্বীকার্য। জনগণের প্রতিক্রিয়াও জানি। বছরের শেষে যে কেলেঙ্কারি ঘটে গেল রাজাকারের তালিকা নিয়ে, তা কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক এমনকি রাজনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়ই বহন করছে। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে আমরা বিগত ৪৮ বছরেও সে তালিকা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গত ১৫ ডিসেম্বর একটি তালিকা তড়িঘড়ি প্রকাশ করে চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিল। রাজাকারদের এই যে তালিকা মন্ত্রী মহোদয় প্রকাশ করলেন, তা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সচেতন নাগরিক ও আদত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও ঘৃণার উদ্রেক করেছে। বিস্ময়করভাবে দেখা গেল বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে রাজনৈতিক নেতা, ব্যক্তিত্ব সারাটা জীবন জনগণের অধিকার আদায়ের পক্ষে কাজ করেছেন, ত্যাগ করেছেন জীবনের সর্বস্ব আর দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ে প্রাণপণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন; তাদের অনেককেই 'রাজাকার' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিদু্যতের মতো এর প্রতিক্রিয়া খেলে গেল সারা দেশে। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ক্ষোভ লক্ষ্য করে সংশোধনের মাধ্যমে নতুন তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের 'রাজাকার' বানিয়ে যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্নস্থানে প্রতিবাদী সমাবেশ সংঘটিত হয়েছে, এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় মানুষের ক্ষুব্ধতা অনেকটাই নিভে গেছে। তবু নতুন করে ২৬ মার্চের আগে শুদ্ধ তালিকা প্রকাশের প্রয়াসকেও 'নতুন বিচু্যতি'র আশঙ্কা জানিয়েছেন অনেকেই কারণ আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য থেকে জানতে পেরেছি তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তালিকা পেয়েছেন সেটাই ছেপে দিয়েছেন। পরে স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন তিনি এ তালিকা প্রকাশের আগে দেখেননি এবং ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এবারে প্রশ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই বা এমন তালিকা কোথা থেকে পেলেন? কেনই বা মিলিয়ে দেখলেন না। সেটা আবার পাঠিয়ে দিলেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে। কী দুঃখের বিষয় নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত কেউ কি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম জানেন না? উলস্নাপাড়ার আব্দুল লতিফ মীর্যা কিংবা সান্তাহারের কসিমউদ্দিন আহম্মেদদের মতন অনেক নিষ্ঠাবান সাহসী মুক্তিযোদ্ধার নাম এই তালিকাভুক্ত হয়েছে। আমাদের ধারণা, এই তালিকা প্রকাশ করার আগে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক কর্মী ও কর্মকর্তাদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর না করে একটি 'প্রতিনিধিত্বমূলক যাচাই-বাছাই কমিটি' সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমেই নাম তালিকাভুক্ত করে প্রকাশ করা উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর শুদ্ধ তালিকা প্রণয়নে যাচাই-বাছাইয়ের সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রয়াস যেন থাকে আমরা নতুন ইংরেজি বছরে তাই প্রত্যাশা করতে চাই। বাংলার ইতিহাস ও লড়াই-সংগ্রামের আদ্যপান্ত লিখিতভাবে আজও গৃহীত হয়নি। ফলে ইতিহাস বিকৃতি, যার যা খুশি সেভাবেই নতুন 'ঘটনাপঞ্জি' যুক্ত করে ইতিহাস সৃষ্টির অপপ্রয়াস করছে তাকে রুখে দেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগে ইতিহাসবেত্তাদের একটি কর্মপ্রয়াস এ বছর থেকেই চালু করুন। এ বাংলার মানুষ হিসেবে আমাদের চাওয়া। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদত ও সম্পূর্ণ জ্ঞান ও পরিচিতি দিয়ে যাওয়া আমাদেরই কর্তব্য। তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ কীভাবে তৈরি করতে হবে তার সত্যিকার শিক্ষা ওরা পেতে পারবে। সেই সঙ্গে সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কেও সব শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

অতীব দুঃখের সঙ্গে দেশের চলমান দিনপঞ্জিতে হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, ভূমি গ্রাস, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের যে অমানবিক পাশব আচরণ সারা বছর ধরে প্রত্যক্ষ করলাম, তা আমাদের চিত্তে চাঞ্চল্য সৃষ্টি অথবা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আমরা কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। সংবাদপত্রের লেখা, টিভির টকশো, কিংবা সচেতন দু-চারজন ব্যক্তির বিবৃতি অথবা দু'একটি ছোট রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ মিছিল বা সমাবেশ এত বড় নিপীড়নকে পরাস্ত করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথা প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন। এ কলঙ্কিত জীবনের বিরুদ্ধে বিচারালয়ের যথার্থ রায়, পুলিশের সঠিক ও সততাপূর্ণ তদন্ত পারে এই সব সমাজবিরোধী কলঙ্কিত চরিত্রকে ঢিট করতে। যদি সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনী অপরাধ নির্ণয়ে সঠিক যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারে তা হলে তার দায়ভার সরকারের ওপর এসেই পড়ে। সুতরাং সরকারকে আরও সজাগ থাকতে হবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। ব্যর্থতায় কুৎসিত ওই অপরাধী চক্রই প্রশ্রয় পাবে আরও জঘন্যতম অপরাধ সংগঠনে।....হত্যা আর ধর্ষণের যে ন্যক্কারজনক ঘটনাবলির কথা শুনছি তাতে আমরা শিউরে উঠেছি। মানুষ হিসেবে কেউ যে এমন শিশু ধর্ষনের ঘটনাও ঘটাতে পারে এটা ইতিপূর্বে আমরা ভাবতে পারিনি। এখনো ভাবতে চাই না। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা নতুন এই ইংরেজি বছরে যেন আমরা কলঙ্কিত ঘটনাবলির যথার্থ বিচার ও শাস্তিবিধান করতে পারি, তা না হলে অপরাধীরাই নির্বিঘ্ন হবে তাই নয় আমরা কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন অবস্থায় ঠেলে দেবো।

আমাদের অস্বাভাবিক যানজট শহুরে জীবনযাপনে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। কত শ্রমঘণ্টা নির্বিবাদে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার যেমন হিসেব রাখছি না, তেমনি উন্নয়নের বিড়ম্বনায় বায়ুদূষণেও যেন তেমন কর্ণপাত করছি না। আমাদের ক্রিকেট টিম যখন দিলিস্নতে খেলতে গেল তখন দিলিস্নর পরিবেশদূষণ নিয়ে আমরা নাক সিটকিয়েছি। অথচ আজ সেই দূষণে আমরাই দুষ্ট। শুধু কি তাই- যে বিকট শব্দ তুলে ট্রাক, লরি, বাস বসতি এলাকার স্কুলের সামনে কিংবা হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শব্দদূষণের সৃষ্টি করে, তা নিয়ন্ত্রণের আজও কোনো পদক্ষেপ দেখি না। নিত্যদিনই রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে যে কোনো পরিবহণের পুরো রাস্তা দখল করে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করি। অথচ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁ দিক দিয়ে গাড়ি চলাচলের স্বতঃসিদ্ধ প্রথা। তাকে নিয়মকরেও শোধরাতে দেখি না। এমনকি, রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে সমানে সাইরেন বাজাতে শুনি, তাতে কারও তাপ-উত্তাপ লক্ষ্য করি না। অর্থাৎ নাগরিক আচরণ সম্পর্কে চালক, ট্রাফিক পুলিশ কেউই তোয়াক্কা করে না। এই তো রাজধানী শহর ঢাকার চালচিত্র। তাতে আবার যানজট নিরসনের 'পবিত্র' প্রত্যাশায় মেট্রোরেলের লাইন বসানোর জন্য শহরময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব লেগে গেছে। হায়, জানিনা এ ব্যবস্থা জট কমাবে না বাড়াবে শহরের রাস্তাই তো কম, তাও আবার অপ্রশস্ত তারপরও একে 'রাজধানী শহর' আখ্যা দিয়েছি। কিন্তু রাজধানীর যা কিছু উপকরণ থাকার কথা সেই নগরায়ণ সঠিকভাবে তো হয়নি, তারপর 'গোদের ওপর বিষফোঁড়া' সৃষ্টি করে তৃপ্তি পাচ্ছি আমরা। বহু বছর ধরে আমরা মোটরগাড়ির লাইসেন্স দেওয়া নিয়ন্ত্রণ এবং পাঁচ বছরের জন্য বন্ধ রাখার কথা বলেছি এবং লিখেছি, তার কোনো হদিস নেই। শহরে প্রতিদিন শত শত যানবাহন বাড়ছে। আবার মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে অগণিত। যে প্রাণহানির জন্য কাউকে আবার দায়ী করতে গেলেও পরিবহণ নেতারা মানুষ হত্যাকে তোয়াক্কা না করে পরিবহণ শ্রমিকদের পাশে প্রবল শক্তি নিয়ে দাঁড়ান। আর ট্রাফিকব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য, দুর্ঘটনায় মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করতেও পারা যাচ্ছে না। ওরা এখন পথচারীর জন্য যে দুর্ঘটনা পথচারীদেরও দোষারোপ করছে। অসর্কতা মানুষকে বিপদে ফেলে, এটা আমরা সবাই জানি। 'ফুটওভার ব্রিজ' রাস্তার যেখানে-সেখানে তৈরি করে ফেলে রাখার চেয়ে অপ্রশস্ত রাস্তায় ট্রাফিক চিহ্ন দিয়ে পুলিশের নজরদারিতে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা নেওয়াটা কি ঠিক নয়? এ বছরে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রেখেছে এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এ বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল মাত্র একটি থাকায় যুদ্ধপরাধীদের বিচার ঢিমে তালে চলছে। এটা প্রত্যাশিত নয়। জানি না সরকার কেন ট্রাইবু্যনাল বাড়াচ্ছেন না এবং এ বিচার ত্বরান্বিত করতে চাইছেন না। তবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে খালেদ ভূইয়া, সম্রাট, জি কে শামীম প্রমুখদের গ্রেপ্তার করে এবং আওয়ামী যুবলীগের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর ফারুক চৌধুরীসহ অনেকের ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে সরকার যে নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রতি সাধুবাদ জানিয়েছে দেশবাসী সবাই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারিসহ ৭৩ জনকে নানা অযোগ্যতার কারণ দেখিয়ে কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমন ঘটনাও বহুল প্রশংসিত হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে যে সমালোচনা হচ্ছে, তাকে যদিও অনুপ্রবেশকারীদের অপকর্ম বলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দিচ্ছেন, তারপরেও প্রশ্ন থাকছে এই অনুপ্রবেশকারী সংগঠনে ঢুকলো কি করে.... জানি না হবে কিনা, তবু প্রত্যাশা করব, আসছে ইংরেজি বছরে যখন 'মুজিব বর্ষ' পালন করা হচ্ছে ও ২০২১-এ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে, যেন তখন এ ধরনের 'ব্যাখ্যা' দিতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

২০১৯-এর উলেস্নখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক ঘটনা হলো ২৭ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ বা ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠান। যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক না কেন এর ফলাফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকার সংরক্ষণ কমিটির প্রতিনিধি নূরুল হক নুরু ও তার দু'একজন ছাড়া ডাকসুর সব পদেই ছাত্রলীগের সদস্যরাই নির্বাচিত হয়েছেন। ডাকসুর জি এস পদে নির্বাচিত হয়েছে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত গোলাম রাব্বানী। সংগঠন থেকে অপসারিত হলেও তিনি তো ডাকসুতে নির্বাচিত জিএস। নির্বাচনের আগে থেকে নূরুল হক নুরুর সঙ্গে ওদের আদর্শিক বিরোধ চলে আসছে। আর সেই বিরোধের কারণেই নুরু ভিপির দায়িত্ব পালন করতে পারছেনই না বরং নয়বার মার খেয়েছে প্রতিপক্ষের হাতে। কোনোবারই প্রহারের দায়দায়িত্ব গোলাম রাব্বানীরা নেননি। সর্বশেষ বেধড়ক মার দিয়েছে ভিপির কক্ষে ঢুকে লাইট অফ করে। এই মারের পর ক্ষমতাশীন দল এই প্রহারের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছে একটা ভূমিকা নিয়ে 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের' তিনজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নুরুর ওপর আক্রমণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এদিকে ভিপি নুরু শাহবাগ থানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ভিপির কক্ষে বেধড়ক মার খাওয়ার পর পাঁচজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একজনকে তো বেশ কয়েকদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও বাহাউদ্দিন নাসিম আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন বারবার নুরুর ওপর আক্রমণ হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন। এদিকে সুযোগ বুঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদাদল অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত শিবিরের কয়েকজন উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তার আগে অবশ্য 'অপরাজেয় বাংলার' পাদদেশে দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েকজন বেশ জোরেশোরেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কথা বলেছেন। আমাদের সবার আশা ছিল দীর্ঘ ২৭ বছর পরে যখন ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তখন তার ফলও আশাব্যঞ্জক হবে। কিন্তু নির্বাচন-উত্তর সময়ে নুরু ও রাব্বানীদের মধ্যে অর্থাৎ ভিপি জিএসের অনৈক্যের যে খতিয়ান লক্ষ্য করছি তাতে আমরা শুধু আশাহতই হইনি বরঞ্চ চিন্তিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতি কী মর্মান্তিক পরিণতির দিকেই না যাচ্ছে। দেখছি একে অন্যকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা ছাড়াও আঘাত করার জন্য অস্ত্রও ব্যবহার করছে। আমরা তো কোনোভাবেই এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

এই আশাহত পরিস্থিতি থেকে নতুন ইংরেজি বছর আমাদের মুক্তি দিক, এটাই কামনা করছি। ডাকসু ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাকিস্তানি জামানার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির চর্চা করবে এটাই প্রত্যাশা করছি। এই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যে সব সচেতন ব্যক্তি নিয়োজিত রয়েছেন, তারা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ছাত্রদের উষ্কানি যেন না দেন, আসছে বছরে সে আশাও করতে চাই। শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বত্র সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসুক এই কামনা রইল।

আমাদের জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক দলগুলোর কি যে ভূমিকা, তা ঠাহর করে উঠতে পারছি না। একযুগ ধরে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগই বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার বিএনপি-জামায়াতের বিরাট যুক্তফ্রন্ট: ২০ দলীয় জোট যে কোথায় উবে গেল, তা হাতড়ে মরছি খুঁজে পাচ্ছি না। এই জোটই আবার কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী, মান্না, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী- এদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কোনো জোট বা ফ্রন্টের 'গলাবাজি' ছাড়া আর তো কোনো কার্যক্রম দেখছি না। মনে হয় দায় বড় বিএনপির। কারণ তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া এতিমের অর্থ আত্মসাতের দায়ে দীর্ঘ কারাবাসে রয়েছেন। বিস্ময়কর ঘটনা হলো দন্ডিত দলীয় প্রধান বিএনপির নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তারই পলাতক পুত্র তারেক জিয়ার হাতে। তিনি কিন্তু রয়েছেন সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারে লন্ডন শহরে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দেউলিয়াপনার এ কী অপরূপ দৃষ্টান্ত? দেশের নাকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দলীয় প্রধান তবে কেন ভরসা করলেন পলাতক পুত্রকে? দেশে কি তাহলে, যারা মাঝেমধ্যে অফিসের অভ্যন্তরে, জিয়ার কবরস্থানে কিংবা প্রেস ক্লাবের আলোচনা সভায়, 'গণআন্দোলন করেই নেত্রীকে মুক্ত করতে হবে' বলেন, অথবা রাজপথের ভয় দেখান, এদের মধ্যে কি কেউই দলীয় নেতৃত্বের দায়িত্বগ্রহণের যোগ্য নন। হায়রে স্বদেশ! এই তোমার বিরোধী দলের চরিত্র। এরাই আবার আওয়ামী লীগ সরকারকে গদি ছাড়া করতে চায়। দেশে যারা বিএনপি করেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো দল ছেড়ে চলেই গেছেন। আর যারা আছেন তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ, আহমদ খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর রায়, নজরুল ইসলাম খান, রুহুল কবির রিজভী অথবা আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নাল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন- এদের মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের মাইক্রোফোনে কথা বলতে শুনি। সেখানে তারা ক্ষমতাসীনদের বেশ ধমকও দেন। কিন্তু হায়রে দুদ্বুদ, সবটাই তার পানিতে মিলিয়ে যায়। এতগুলো বছর চলে গেল তথাকথিত বিরোধী দল কেবলই 'লেজনেড়ে' গেল আঘাত হানতে পারল না। .... একেই কি বিরোধী দল বলে? তাহলে আমরা কি ভাবতে পারি যে, দেশের 'বৃহত্তম' বিরোধী দল যত অন্তর্দ্বন্দ্বই থাক না কেন সামনের বছর খোলস থেকে বেরিয়ে 'ফোস' করে উঠবে? যদি তা হয় তবে তো ভালো। এমন প্রত্যাশাই রইল।

দেশ ও জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল বলেই ৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে সবাই জানপ্রাণ দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলাম এবং তথাকথিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা দেশপ্রেমিক মুক্তিফৌজ প্রাণপণ যুদ্ধে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। আমাদের তো তাই প্রত্যাশা বিজয়ী স্বদেশ যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে নিজেদের গড়ে তুলতে পারি, সে আশাই সর্বক্ষণ করছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা প্রভূত উন্নয়ন সাধন করছি, আমাদের প্রবৃদ্ধিতে সমৃদ্ধি আসছে, জনগণ সচেতন হয়েছি আগের তুলনায় ঢের বেশি; কিন্তু একি, আমরা কেন পাকিস্তানি জামানার মৌলবাদী প্রেতাত্মাকে নতুন করে প্রশ্রয় দিয়ে ওই হেফাজতের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে দীক্ষিত করতে চাইছি? মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কুৎসিত চক্রান্ত কৌশলে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইছে 'আইয়ামে জাহেলিয়াত'-এর যুগে।

ধর্মান্ধতার ভূত আকস্মিক চেপে বসেছে আমাদের কাঁধে, একে ঝেড়ে ফেলতে হবে। না হলে যে বঙ্গবন্ধুর 'অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ' তথা স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব না। এমনই ব্যর্থতা দিয়ে আমরা কি মুজিব বর্ষকে আবাহন করতে চাই?

\হনা, চাই না। ধর্ম নিরপেক্ষতার দীক্ষায় দীক্ষিত হবে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, তাতেই তো আমরা সমাজতান্ত্রিক চরিত্র ধারণে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ধনশালী করতে চাই। মাদকাশক্তি, নানা বর্ণের দুর্নীতি সর্বোপরি ধর্মান্ধতার পরিবেশকে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কপালে বিজয় তীলক এঁকে দিক, এই তো বিজয়ী বাংলার রক্তিম শপথের অঙ্গীকারে প্রদীপ্ত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা। সামনের ইংরেজি বছর যেন তারই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে মুক্ত স্বদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে এই কামনাই রইল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির কাছে।

কামাল লোহানী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বিশিষ্ট সাংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<82393 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1