'প্রতিবন্ধী ব্যক্তি'- সেবকদের প্রতিবন্ধকতার অবসান হোক

সমাজে যারা ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষা করছে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র।

প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আশরাফ আহমেদ
প্রতিবন্ধিতা মানবজীবনের একটি বৈচিত্র্য। প্রতিবন্ধিতা রোধে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। গর্ভবতী মায়েদের সুষম খাবার, নিয়মিত টিকা গ্রহণ, চিকিৎসকের পরামর্শ, নিরাপদ প্রসূতি সেবার মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এরপরও নিউমোনিয়া, খিঁচুনি, অপুষ্টি, নির্ধারিত তারিখের পূর্বে জন্মগ্রহণ, উপযুক্ত পরিবেশে এবং ডাক্তারের সহযোগিতা ছাড়া প্রসব হওয়ার কারণে এখনো অনেক প্রতিবন্ধিতার স্বীকার হচ্ছে। ডঐঙ-এর সমীক্ষা অনুযায়ী তৃতীয় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জরিপের মাধ্যমে প্রায় ১৭ লাখ লোককে প্রতিবন্ধী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং কার্যক্রম এখনো চলমান। এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান হলো- সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ভুক্ত  জা. প্র. উ. ফা.। এর আওতায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রথম ৫টি সেবাকেন্দ্র নিয়ে এই কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়। এগুলো হলো- ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ এবং জামালপুর। এ সেবাকেন্দ্রগুলোর সফলতা বিবেচানা করে সরকার এই কেন্দ্রের পরিধি আরও বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০-১১ অর্থবছর আরও ২০টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে আজ সারাদেশে ১০৩টি সেবাকেন্দ্র চালু আছে। এসব কেন্দ্রে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিয়োজিত আছেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য। ধূপের মতো পুড়ে পুড়ে যারা গন্ধ বিলিয়ে যাচ্ছে, একটু একটু করে প্যারালাইসিসের দেহে প্রাণ সঞ্চার করছে- তাদের কথা একটু ভাবুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি জানলে হয়ত ব্যথিত হবেন যে, এই ১০৩টি সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের প্রায় ১ হাজার ২০০ জন কর্মকর্তা এবং কর্মচারী সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনীর (এনক্রিমেন্ট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন) কোনো রকম সুবিধার আওতায় এই বিশাল জনবল নাই। একটি ছোট গাছের চারা জন্মানোর পরে ছাগলে খেয়ে ফেলতে পারে কিন্তু আস্তে আস্তে চারা গাছটি বৃক্ষে রূপান্তরিত হলে বিশাল হাতি বেঁধে রাখা সম্ভব এই বৃক্ষের সঙ্গে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র ওই রূপক চারা গাছের মতো, বৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটু পরিচর্যা এবং সরকারের সুদৃষ্টি। যে ঘরে একটি প্রতিবন্ধী বাচ্চা আছে তাদের মা-বাবা এবং আত্মীয়-স্বজনই জানেন এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কতটা কঠিন, দুরূহ আর কষ্টসাধ্য। শুধুমাত্র এই কেন্দ্রটি সেবা প্রদানের মাধ্যমে তারা হয়ে উঠেছে আত্মার আত্মীয়, পরম বান্ধব। একটু অন্তর আত্মা দিয়ে ভাবলে দেখা যায় স্টোক পরবর্তী প্যারালাইসিসের পরে যখন অনেক মানুষ অন্যের সাহায্য ছাড়া শুয়ে বাম অথবা ডান দিকে কাত হতে পারেন না সেখানে সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র ফিজিওথেরাপিস্ট, থেরাপি সহকারীর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ওই ব্যক্তি একটু একটু করে উঠে বসতে শেখে, বিভিন্ন ধরনে থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ, ইলেকট্রো থেরাপির মাধ্যমে। শুধু বসতে শিখলে তো হবে না, তাকে দাঁড়াতে সক্ষম করে তুলতে হবে। শুধু দাঁড়া হলেও চলবে না তাকে তার স্বীয় কাজে অথবা তার সক্ষমতা অনুযায়ী একটি কাজে নিযুক্ত হতে হবে। সেক্ষেত্রে সেবাকেন্দ্রের অকুপেশনাল থেরাপিস্ট দক্ষ নাবিকের মতো ডুবন্ত তরীকে কূলে ফেরাবে তার অভিজ্ঞতা, আন্তরিকতা এবং নিজস্ব শিক্ষণ অনুযায়ী। এতে ওই ব্যক্তি মুক্তি পাবে বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে এবং পাবে নবজীবন। এক্ষেত্রে থেমে থাকবে না অডিওমেট্রিশিয়ান এবং অপটোমেট্রিয়ান। স্পিচ অ্যাস্ট্রো ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট আন্তরিকতা এবং তার নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে কথা বলানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা কার্যক্রমের অংশগুলো হলো- প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শনাক্তকরণ, অনুধাবন ও পরিকল্পনা; স্বাস্থ্যসেবা, ভাষা ও যোগাযোগ; প্রবেশগম্যতা, তথ্য বিনিময় এবং তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি; চলন, সহায়কসেবা এবং পুনর্বাসন, শিক্ষা ও প্রতিক্ষণ, কর্মসংস্থান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পারিবারিক সমাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সমঅধিকার নিশ্চিতকল্পে সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এই আইন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো- প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, জনপরিবহণে আসন সংরক্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভর্তি সংক্রান্ত বৈষম্যের প্রতিকার, গণস্থাপনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণ, প্রতিবন্ধিতার কারণে কর্মে নিযুক্ত না করা এবং বৈষম্য নিষিদ্ধকরণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদান- এই আইনের ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অনেক সুফল পেতে শুরু করেছেন। যেখানে আগে প্রতিবন্ধী বাচ্চাদেরকে ঘরে লুকিয়ে রাখা হতো, জিনে ধরা, ভূতে ধরা অথবা মা-বাবার পাপের ফসল হিসেবে প্রতিবন্ধী বাচ্চা জন্মেছে বলে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমান প্রতিবন্ধীবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা, কৃপাদৃষ্টি এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্পেশাল অলিম্পিকে সোনা জয় করে এনে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান করেছে সুদৃঢ়। সমাজের অবহেলিত মানুষের পাশে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানের বাবা ও মায়ের মুখের হাসি ফুটিয়েছে। মোবাইল থেরাপিভ্যানের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সেবা প্রদান করে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র। বিনামূল্যে সহায়ক উপকরণ প্রদানের মাধ্যমে চলাফেরার সক্ষমতা ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও সেবা প্রদান করা হয়। আর এই প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক সব নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরকারের প্রদানকৃত নির্দেশনা সুচারুরূপে বাস্তবায়নই প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তার কাজ। সমাজে যারা ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষা করছে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র। সার্বিক প্রতিবন্ধী জরিপ করার কাজে সহায়তা করেছে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র। অতএব, সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের বিকল্প কিছু নেই এবং প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এর প্রাণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এরকম একটি অবহেলিত পশ্চাৎপদ নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যারা কাজ করে মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনছেন তাদের অবশ্যই মূল্যায়িত হওয়া উচিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং তাদের প্রত্যেকেরই চাকরির নিরাপত্তা প্রয়োজন। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা প্রান্তিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের উলেস্নখিত কার্যক্রম ২০১০ সাল থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পরিচালনার জন্য সর্বপ্রথম সমাজসেবা অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন পরিচালনার জন্য অনুরোধ করে, সে লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ২০০৯ সালে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র সেবামূলক কর্মসূচি চালু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে। এই ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পারিচালনার জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে তাদের দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়- যাদের মাধ্যমে এই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে সুদীর্ঘ ১০ বছর ধরে সেই প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। গত প্রায় এক দশক ধরে ১ হাজার ২০০ জন জনবল এই বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে আসছে। পরিতাপের বিষয় হলো- তাদের সাকুল্য নামমাত্র বেতন ছাড়া কিছুই প্রদান করা হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  আমাদের বিশ্বাস, আপনার হয়তো দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের এই ১ হাজার ২০০ জনবলের করুণ কাহিনি। একই বেতন-ভাতায় খুবই মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে এই সব জনবলের। আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়া এই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার সম্মুখ সমোরহের সৈনিকদের বাঁচানো সম্ভব নহে। আজ ২ জানুয়ারি ২০২০ জাতীয় সমাজসেবা দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য, 'সমাজসেবায় দেশ গড়ি, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করি'- এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ ও লালন করে আমাদেরও প্রত্যাশা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তাদের প্রাণের নীড় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের সব সেবকদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদানের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সদয় নির্দেশনা প্রদান করবেন বলে আমরা বিশ্বাস রাখি। আশরাফ আহমেদ: গবেষক ও কলাম লেখক