বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘ ও আমাদের প্রত্যাশা

সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে মিয়ানমার সরকার। ২ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের জন্য শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টাই নেই মিয়ানমারের।
মো. সাইফুল ইসলাম
  ০৩ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বশান্তি রক্ষার প্রতিশ্রম্নতি নিয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর বর্তমান জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতিসংঘের প্রারম্ভে ৫১টি দেশ একত্রে বসে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে। সেই থেকেই জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ এ পর্যন্ত ০৯ (নয়) জন সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ করেছে এবং প্রতিটি সেক্রেটারি জেনারেল তাদের সাধ্যের মতো করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় দৌড়ঝাঁপ করেছেন এবং বহু পরিশ্রম করে বিদায় নিয়েছেন। প্রশ্ন হলো- জাতিসংঘ কি বিশ্ববাসীর কাঙ্ক্ষিত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? সে সময়ের বিশ্ববাসী যে শান্তিময় বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন আর আজ আমরা যে শান্তিময় বিশ্ব কামনা করছি তা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ পুরোপুরি সফল হবে কি?

বিশ্বশান্তির কোনো ছাপই নেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র বা তার জনগণের জীবনে। ইসরাইল পরাশক্তি না হলেও একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজ সিদ্ধান্তেই যখন ইচ্ছা ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ করছে, ঘরবাড়ি ধুলোর সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, অকাতরে অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। একের পর এক ফিলিস্তিনিদের গুলতি ও পাথর ছোড়ার দৃশ্য একুশ শতকেও পুরনো মনে হয় না। অন্যদিকে ইসরাইল কর্তৃক ইহুদি বশতবাড়ি গড়ে উঠেছে ফিলিস্তিনিদের আবাশ ভূমিতে, জাতিসংঘের নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে।

আজ বিশ্বের প্রতিদিনের প্রতিটি খবরের কাগজে আফগানিস্তানের কোনো না কোনো খবর ছাপা হচ্ছে। আফগানদের বড় ধৈর্য, কখনো সোভিয়েতকে সামলায় আবার কখনো আমেরিকাকে সামলায়। এখানে জাতিসংঘ যেন কখনো সোভিয়েত আবার কখনো আমেরিকার খুঁটিতে বাঁধা পড়ে যায়। তাই প্রতিদিনের মৃতু্যর খতিয়ান তুলে রাখা এবং জরুরি ত্রাণ পাঠানোই যেন একমাত্র কাজ হয়ে দেখা দেয়।

আবার বসন্তের বাতাসে যেসব আরব দেশে ফুল ফুটেছে, কত ফুল ফুটেছে তার খবর বিশ্ববাসী না জানলেও কত অবুঝশিশু, কত নারী আর পুরুষের প্রাণ ঝরেছে মৃতু্যকূপে তা সবার জানা আছে। ইরাকযুদ্ধে আমেরিকা সাদ্দাম হোসেনকে পরাজিত করে কিন্তু এ যুদ্ধে ইরাকের কয়েক লাখ লোক নিহত হয়। এ যুদ্ধ চলাকালে আমেরিকা, ইরাকে বেশকিছু মানবিক সাহায্যও পাঠায়। একদিকে যুদ্ধে বাবা-মা হারা শিশুরা যেমন দিশাহারা হয়েছিল তেমনি মন্দের ভালো হিসেবে পেয়েছিল মানবিক সাহায্য। তাই ইরাকের রাস্তায় বহু শিশু আক্ষেপ করে পেস্ন কার্ড হাতে নিয়ে বের হয়েছিল, বহু পথ তারা পাড়ি দিয়েছিল, দাবি তুলেছিল এ যুদ্ধ বন্ধের। তারা পেস্নকার্ড আমেরিকাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে লিখেছিল 'ঞযধহশ ণড়ঁ ইঁংয টহপষব ভড়ৎ ইরংপঁরঃ ধহফ ইড়সন' বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি আরেক কারণ ইয়ামেনের হুতো যোদ্ধাদের সঙ্গে সৌদি আরবের জোটের মধ্যে যুদ্ধ। আমেরিকার মদদে ও পরোক্ষ সাহায্যে চলছে সৌদি আরব ও ইয়ামেনের হুতোগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ। ইতোমধ্যে সৌদি হারামখোর তেল কোম্পানির দুটি তেলক্ষেত্র হুতো বিদ্রোহীদের ড্রোন হামলায় তেল ক্ষেত্রের বেশ ক্ষতি হয়েছে। এই হামলার ফলে বিশ্বের তেল উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। বিশ্বশান্তি একটু একটু করে সীমাহীন গিরিখাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিপর্যস্ত হচ্ছে বিশ্বমানবতা।

সিরিয়ার প্রতিদিনের প্রাণহানি আমাদের পিড়া দেয়। আমাদের ভালো লাগে না প্রতিদিন এ মৃতু্যর মিছিল দেখতে। বিশ্বের দেশে দেশে এ মৃতু্যর মিছিল আমাদের পূর্ব-পুরুষদের পিড়া দিত, এ যুগে আমাদেরও পিড়া দেয়, ব্যথিত করে, নির্বাক করে। আমরা বিশ্ববাসী শুধুই অবাক দৃষ্টিতে একটু মানবতা, একটু ন্যায়-বিচার, একটু শান্তির জন্য জাতিসংঘের দিকে চেয়ে থাকি।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের রয়েছে বহু অবদান যা আজ পুরো বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অভিষেক হয় ১৯৭৮ সালে। বর্তমান বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৫০৫৩ সদস্য পৃথিবীর বহু দেশে কর্মরত। এ পর্যন্ত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১১৮ জন সদস্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। আমরা তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। বিশ্বে খুব কম দেশেই আছে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যাদের সেনাবাহিনীর এত অধিকসংখ্যক সদস্য নিহত হয়েছে।

সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে মিয়ানমার সরকার। ২ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের জন্য শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টাই নেই মিয়ানমারের।

আজ পর্যন্ত যে সব ব্যক্তি এ বর্বরোচিত, জঘন্য হত্যাকান্ড পরিচালনা করল, আদেশ দিল তাদের কাউকেই বিচারের কাঠগড়াতে দাঁড় করাতে পারেনি জাতিসংঘ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি যে মানবতা দেখিয়েছেন তা ভোলার নয়। বিশ্ববাসী এজন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তার এ মানবতা বিশ্ববাসীর কাছে চির অম্স্নান হয়ে থাকবে।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বৃহৎ ৫ শক্তি তাদের নিজ স্বার্থেই তার দেশের পররাষ্ট্র নীতির বাইরে এসে এখন পর্যন্ত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো চমক প্রদর্শন করতে পারেনি। তাই বিশ্বের বহু দেশেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ বেঁধেছে, গৃহযুদ্ধ বেঁধেছে, বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর কাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ এখনো আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি। জাতিসংঘের এ ব্যর্থতার দায়ভার জাতিসংঘের মহাসচিব বা তার কোনো অঙ্গসংগঠনের নয় বরং এ ব্যর্থতা বৃহৎ ৫ শক্তির ইচ্ছায় অথবা নীরবতার জন্যই হয়েছে।

বিশ্ববাসীর হাজারো নিহত ও আহতের ঘটনায় জাতিসংঘের কম-বেশি সব জায়গাতেই ত্রাণকার্য চালিয়ে দুর্গত, দুর্দশাগ্রস্ত, মানুষের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের অসহায়ত্ববোধ, মানুষের দুর্দশাকে কিছুটা হলেও জাতিসংঘ কমাতে সক্ষম হয়েছে। আর্তমানবতার এই মহান সেবায় জাতিসংঘ বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত ও আস্থার মুখ। একবিংশ শতাব্দীর জাতিসংঘের কাছে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা অনেক। জাতিসংঘ অবশ্যই তার স্থায়ী ৫ সদস্যকে বোঝাতে সক্ষম হোক যে এ স্থায়ী সদস্যদের বিশ্ববাসীর সেবায় তাদের নিয়োজিত করবেন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং এ ৫টি দেশেই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজ পতাকায় নয় বরং জাতিসংঘের পতাকার নিচে অবস্থান নেবেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় স্থায়ী এই ৫টি দেশ সব পরমাণু অস্ত্ররোধে সমঝোতায় পৌঁছাবেন। অন্যান্য পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রকে এই পরমাণু সমঝোতার শরিক করবেন অথবা বাধ্য করবেন। বিশ্ববাসী আর যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। তাই বৃহৎ শক্তির ৫টি দেশ সব যুদ্ধগ্রস্ত দেশে শান্তির বার্তাকে আরও বেগবান করবেন। গণহত্যার রস্ত্র নায়ক, মহানায়কদের যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করবেন। আজ জাতিসংঘ ক্ষুধামন্দার বিরুদ্ধে যতটুকু সোচ্চার তার চেয়েও বেশি সোচ্চার হউক যুদ্ধবিগ্রহ কমাতে, বিশ্ববাসীর সেটাই কাম্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণ খুঁজে বের করে তার বিরুদ্ধে দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্যের ব্যবস্থা করা। আর হাজারও চাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো বর্তমান বিশ্বে যেভাবে সাদা-কালো, ধর্মে ধর্মে, জাতিগত বিভেদ, যে হিংসা, যে হানাহানির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে তা দ্রম্নততার সঙ্গে সবাইকে বোঝানো। যেসব রাষ্ট্রনায়করা বুঝে না বুঝে বর্ণবাদ, ধর্মীয় বিভেদ, জাতিগত বিভেদের তীব্র ধ্বংসাত্মক বীজ রোপণ করছেন তা দ্রম্নত উপড়ে ফেলা। সারা বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা।

আজ জাতিসংঘের কাছে বিশ্ববাসীর সর্বশেষ প্রত্যাশা জাতিসংঘ বেঁচে থাকুক বিশ্ববাসীর শান্তি বুকে নিয়ে।

মো. সাইফুল ইসলাম: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<82618 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1