বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

বঙ্গবন্ধু সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে শিল্পের জাতীয়করণ করেন এবং এসবের মধ্যদিয়ে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে সক্ষম হন।
জোবায়ের আলী জুয়েল
  ১০ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ইতিহাসের চলার পথের শেষ নেই। শেষ নেই তার চলন্ত রথচক্রের গতিধারার। ইতিহাস চলতে চলতে হঠাৎ শুনতে পেল ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত।

পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ার লাইন্সের একটি বিশেষ জেট বিমানে ৬টা ৩৬ মিনিটে হিথরো বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু এসে পৌঁছেছেন। এর তিন ঘণ্টা পরে বঙ্গবন্ধু সেন্ট্রাল লন্ডনের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দর ত্যাগ করলেন। হিথরো বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বললেন, 'আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, আমি বেঁচে আছি, আমি সুস্থ রয়েছি।'

লন্ডন বিমান বন্দরে এসে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বললেন- 'স্বাধীনতার লক্ষে পৌঁছতে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত বেশি প্রাণদান আর ভয়াবহ দুর্ভোগ আর কোনো দেশের মানুষকে পোহাতে হয়নি। ...এই মুহূর্তে আমি আমার দেশবাসীর কাছে ফিরে যেতে চাই। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারছি না। ...আমার দেশবাসী আমাকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেছেন। অথচ আমাকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ একটি নির্জন পরিত্যক্ত সেলে আটকে রেখেছিল তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে। ফলে আমাকে সর্বদা ফাঁসির কাষ্ঠের জন্য প্রহর গুনতে হয়েছিল।...প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটা বিবেচনা করতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আমি তাকে বলেছি আমার দেশবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোনো কিছু বলতে পারব না।'...

বিশ্বের চাপের মুখে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে ৮ জানুয়ারি মুক্তি দেন। ৮ জানুয়ারি লন্ডন পৌঁছে হোটেল থেকে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান।

লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের সিনিয়র কর্মকর্তা এ করিম বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান।

এই দিন নয়াদিলিস্ন থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ভাড়া করা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বোয়িং বিমান বঙ্গবন্ধুকে আনার জন্য লন্ডনের পথে রওনা হয়ে যায়। ১০ জানুয়ারি রয়েল এয়ার ফোর্সের কমেট বিমানযোগে ড. কামাল হোসেনসহ দিলিস্ন পৌঁছলে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে সংবর্ধনা জানান। দিলিস্নর প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসমাবেশে আবেগময় ভাষণ প্রদান করেন। ১০ জানুয়ারি বেলা ১.৪১ মিনিটে বাংলার নয়নমণি নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করেন।

মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম অগ্রসৈনিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে বললেন 'আমি রাজনীতি করি না, কোনো দিন করতাম না, ভবিষ্যতেও করব না। আমি শান্তিপ্রিয় বাঙালি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে আমি যে নতুন যুগ আর পথের সন্ধান পেয়েছি, সে জন্য তাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা তাকে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলেন।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি এ দিনটি বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন এশিয়ার রাজনৈতিক গগনে ম্রিয়মাণ আকাশে নতুন সূর্যের আবার আবির্ভাব হলো তার জলন্ত শিখা নিয়ে। সেই রশ্মির দীপ্ত আলোতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল সাড়ে সাত কোটি ম্রিয়মাণ বাঙালির বিশুষ্ক বদন মন্ডল। তিনি ফিরলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, ফিরলেন বাংলাদেশে- পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন থেকে ভায়া দিলিস্ন হয়ে তিনি ফিরে এলেন। জয় করে নিয়ে এলেন বিজয় মাল্য বিশ্বের রাজনৈতিক গগন থেকে। হাতে বন্ধুত্বের রাখি বেঁধে নিয়ে এলেন ভারতের রাজধানী দিলিস্ন থেকে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাকে ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে যে সম্মান-শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রদর্শন করলেন- এমন শ্রদ্ধার সংবর্ধনা ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যে জোটেনি। আন্তরিকতার মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি এই গৌরবময় সংবর্ধনা। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি ইতিহাসের গৌরবদীপ্ত দিন। আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে এই দিন বেলা ১.৪১ মিনিটে বাংলার নয়নমণি নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার উদ্দেশ্যে আবেগময় ভাষণ দেন। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে।

দিলিস্ন থেকে ঢাকায় এসে তার অগণন ভক্ত বাঙালি ভাই-বোনদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন- আর আনন্দে বুক ভরে ফেললেন। ভাষণে তিনি তার বন্দি জীবনের কথা বললেন। বাংলাদেশ থেকে অতিসত্তর ভারতীয় সৈন্য চলে যাবে এ কথা জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতি এবং তার নিজের জীবন রক্ষায় বিশ্বমত সৃষ্টির জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু সগর্বে বললেন-

কবিগুরু, বাঙালি আজ আপনার কবিতার বাণী-

'সাতকোটি বাঙালিরে হে বঙ্গ জননী,

রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি'।

মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে আবার হয়তো দুঃখী, দরিদ্র জনগণের কথা মনে করে তার প্রাণ বীণায় 'নাজিম হিকমতের কাব্যের সুর বেজে উঠেছিল-

'আমি জানি, দুঃখের ডালি

আজও উজাড় হয়নি

কিন্তু একদিন হবে'।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অধ্যায় শেষ করলেন। এবার সোনার বাংলা গঠনের দায়িত্ব মুখ্যত তারই। কোটি কোটি বাঙালি জনতার দুঃখ লাঘবের দায়িত্ব একান্তভাবে তার এবং তার আওয়ামী লীগ দল ও মন্ত্রিসভার। বাঙালি জাতির প্রাণঢালা সংবর্ধনার ডালি মাথায় বয়ে নিয়ে জাতির জনক রণক্লান্ত কান্ডারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান পদটি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে উপহার দিয়ে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'দেশগড়ার সংগ্রাম'-এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলেন। তিনি তার মন্ত্রিসভায় সহকর্মীরূপে গ্রহণ করলেন সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী, খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আযাদ, ডক্টর কামাল হোসেন, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকী, জেনারেল এমএজি ওসমানী, শেখ আবদুল আজিজ, মোলস্না জালাল উদ্দিন, আবদুল মান্নান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ড. মফিজ উদ্দিন, মতিউর রহমান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সোহরাব হোসেন, আবদুল মালেক উকিল, আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ফণীভূষণ মজুমদারকে।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে জাতীয় পতাকার নকশা, জাতীয় সংগীত, রণসংগীত, ডাক টিকেট, শহীদ মিনার নির্মাণ ইত্যাদি অনুমোদনদানের মধ্যদিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ধ্বংসস্তূপের ওপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের পথচলা। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ১৫ মার্চ ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশে প্রত্যাবর্তন করে।

বঙ্গবন্ধু সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে শিল্পের জাতীয়করণ করেন এবং এসবের মধ্যদিয়ে দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে সক্ষম হন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ শুক্রবার একদল বিশ্বাসঘাতক নরপশু, সেনা কর্মকর্তা নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে জাতির জনককে সপরিবারে খুন করল। নববিবাহিত বধূ কিংবা শিশু রাসেলও রেহাই পেল না। শুরু হলো অন্ধকার জগৎ।

বাংলাদেশের মানুষের জীবন হাসি-আনন্দ আর দুঃখ-বেদনার বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। তারা মরতে মরতে বেঁচে উঠেছে, আবার বাঁচার জন্য মরণপণ করে লড়ছে। তারা বাঁচার জন্য সে সময়ের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত শ্মশান বাংলাকে আবার সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য দেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছে। গারো পাহাড়ের নিচে যে বাংলা, পদ্মা- মঘনা-মধুমতি, ইছামতি-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গার বুকে যে বাংলা, যে বাংলার পদপ্রান্তে বঙ্গোপসাগর, সেই বাংলাকে বিশ্বের আজ প্রায় সব দেশই স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষ আজ গভীর আগ্রহ নিয়ে পূর্বাচলের রক্তাকাশের নবীন সূর্যকে অবাক বিস্ময়ে উন্মুখ হয়ে দেখছে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের পতনের পর বাঙালি জাতির নব উত্থানের পথে যে সূর্য তাদের ভাগ্যাকাশে উদিত হলো, সে সূর্যের প্রখর রশ্মিকন্যা অঙ্গে মেখে বাংলার উর্বর মাটি কোন ফসল আজ ফলাবে? সোনার দানা না আরও মূল্যবান কিছু? সোনার বাংলার সূর্যসেনাদের বুকে আজ অযুত সেনার বল, দেশ গড়ার হিম্মত। কণ্ঠে তাদের-

'আমার সোনার বাংলা

আমি তোমায় ভালোবাসি'।

জোবায়ের আলী জুয়েল: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83678 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1