এই কি আমাদের সোনার বাংলা

ঢাকায় নারীদের ওপর অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। থার্টিফার্স্ট নাইট বলে পরিচিত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে কয়েক বছর আগে এক নারীকে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। আর এবার ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা।

প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
এ দেশের মানুষের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল পাকিস্তান আমলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শুধু একটা স্বাধীন জনপদ সৃষ্টি নয়, সেই সঙ্গে মুক্তজীবন ও সাবলীল সমাজ গঠনের অঙ্গীকার। যে সমাজে থাকবে না কোনো বৈষম্য আর অন্যায়, থাকবে স্বাধীন জীবনচর্যার অধিকার। একটা সোনালী আদর্শ নিয়ে সর্বশ্রেণির মানুষ যুদ্ধ করে শুধু স্বপ্নের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। কিন্তু সত্যিই কি বাংলাদেশ নামে একটা সার্বভৌম স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার পর মানুষ বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেছে? বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সোনার ওপর ক্রমেই খাদ পড়ে তার আকার বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ-পূর্ব ও পরে এ দেশের শিক্ষার্থী সমাজের যে সাহসিক অবদান ছিল তা আজও আঘাতের পর আঘাতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। এরশাদ সাহেবের আমলে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ন' মাস বন্ধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে শিক্ষার্থীরাই অবরোধ অস্বীকার করে নিজেরাই ক্লাস খুলে দিয়েছিল। সরকারের কোপে রাস্তায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গাড়ি চাপা দিয়ে অত্যাচার করা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে অনেক শিক্ষার্থীদের পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রোকেয়া হলের ভেতরে ছাত্রীরা কাঁধে রাইফেল তুলে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল অগ্রণী ভূমিকা আর শিক্ষাক্ষেত্রে ছিল সুনামের অধিকারী। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চমকে উঠল নতুন বছরের শুরুতে জানুয়ারির ৫ তারিখের ঘটনায়। একটা নিকষ কালো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। বাড়ি ফেলার পথে একজন ছাত্রীর নারী হিসেবে সে যে সম্মানের অধিকারী, তার জীবন থেকে সেই সম্মান কেড়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কারা এই দুর্বৃত্ত? যারা সমাজ, শাসন, আদর্শ, ভালোবাসা, মা-বোন, সন্তানের সম্ভ্রমকে অস্বীকার করে নিজেদের ইচ্ছাকেই প্রধান বলে মনে করে। এ দেশে নারীর ওপর প্রতি বছর এই অসম্ভ্রমের ঘটনা ঘটে থাকে, যার সংখ্যা কম নয়। সব ক্ষেত্রে এই ঘটনার প্রতিকার হয় না বিভিন্ন কারণে। কোথাও রাজনীতি, কোথাও বিত্তের প্রভাব আবার কোথাও সমাজে স্থায়ী শক্তির কারণে। নারীর এই অসম্মানের একাধিক কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধান হলো কোনো নারীর সঙ্গে শত্রম্নতা ও নারীর প্রতিরোধের কারণে। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায় কোনো পুরুষ বিশেষ নারীর প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণে তাকে বিয়ে অথবা সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। এসব ক্ষেত্রে নারীরা অসম্মত থাকার কারণে পুরুষরা তার প্রতিশোধ হিসেবে এককভাবে বা দলীয়ভাবে তার সম্মান হানি করে থাকে। আরও একটি প্রধান দিক হলো নারীদের অসহায় অবস্থায় তাদের ওপর আক্রমণ করে নিজেদের মানসিকতা চরিতার্থ করা। এ দেশের সমাজ-কাঠামো ও পুরুষের মানসিকতা বিপুলভাবে পরিবর্তিত হওয়ার কারণে রাস্তাঘাট, বাস বা অন্যত্র সুযোগ পেলেই ফাঁদ পেতে নারীদের ওপরে অবাধে আক্রমণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। প্রশাসনিক দুর্বলতা, জৈবিক ইচ্ছা, কঠোর আইন-কানুনের অভাবই এই শ্রেণির ঘটনার জন্ম দেয়। ব্রিটিশরা অবিভক্ত ভারত শাসন করার সময় এ দেশের মানুষের মনোভাব উপলব্ধি করে প্রতিটি শহরে একাধিক পতিতালয় স্থাপন করে। তার ফলে সাধারণ নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টি পড়েনি এবং তাদের কড়া শাসনের কারণে ও সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারেনি। পাশ্চাত্য দেশের মধ্যে হল্যান্ডও যে পতিতালয় তৈরি করে তা আজও আগের মতো সমানভাবে চলছে। অবশ্য পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের তুলনা করা ঠিক নয়, কারণ নারীর চেতনাবোধ দুই অঞ্চলে সমান নয়। প্রাচ্যে নারীরা নিজেদের সতীত্ববোধকে সবচেয়ে বড় মনে করে এবং তার স্খলনে সমাজ-বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। পাশ্চাত্য দেশে নারীদের দৈহিক চেতনা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এই কারণে সবার মধ্যে প্রাচ্যের শুচিতাবোধ অবিদ্যমান। অনেকটা ফ্রি সোসাইটি বলে অল্প বয়েস থেকে তরুণ-তরুণীরা অথবা বিবাহোত্তর সময়েও নর-নারীর মিলন স্বাভাবিক। হল্যান্ডের মতো পাশ্চাত্যে পতিতালয় না থাকলেও রাস্তায় ভাসমান পতিতালয় না থাকলেও রাস্তায় ভাসমান পতিতার অভাব নেই। এখানেই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিলনহীনতা বিদ্যমান। প্রাচ্য-নারীর দৈহিক-শুচিতা সংরক্ষণ সামাজিক আদর্শের কারণেই প্রাধান্য বিদ্যমান। একজন নারীর সম্মানহানি সমাজের মানুষের চোখে বিপ্রতীপ প্রভাব বিস্তার করে। শুধু একজন নারীই নয়, তার পরিবারকেও বিপদগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া নির্যাতিতা নারীর বিয়ে অনেকাংশে কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ একদিকে একশ্রেণির কঠোর অলিখিত আইন করেছে, অন্যদিকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বিন্দুমাত্র কঠোর নয় বলে নারীকেই গঞ্জনার শিকার হতে হয়। অথচ এ দেশের সামাজিক কাঠামো ও পুরুষের মানসিকতা সমশ্রেণির ছিল না। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের অন্য শহরেও প্রাক-বাংলাদেশ আমলে মেয়েরা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ি থেকে বা হল থেকে হেঁটে হেঁটেই যাতায়াত করত। তাদের কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়নি। ট্রেনেরও নারী ও পুরুষদের স্বতন্ত্র কামরা ছিল বলে স্বাধীনভাবেই চলাচল করেছে। কোনো পুরুষ কোনো সময় জোর করে নারীদের কামরায় ওঠার চেষ্টাও করেনি। এই শ্রেণির দৃষ্টান্ত থেকে মন্তব্য করা যায়, নারীর প্রতি আগে যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা বর্তমানে অনেকাংশেই বিলুপ্তির পথে। এই শ্রেণির মানসিকতা মানুষের জীবনে শুধু ক্ষয়ই সৃষ্টি করে, মূল্যবোধ সৃষ্টি করে না। প্রশাসনিক নিয়ম কঠোর হলে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্ভ্রমবোধ বজায় রাখতে সহায়তা করে। সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করলেও কথা বলার কোনো নিয়ম ছিল না এবং তা পুরুষ ও নারী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন বলে একসঙ্গে কাজ করতে কারুর অসুবিধে হতো না। এভাবেই নারী তার স্বাধীনতা বজায় রেখে সর্বত্র কাজ করতে পারতেন। বাংলাদেশে নারীদের একা চলা, বিশেষভাবে রাতের বেলায়, ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নারী-শত্রম্ন সর্বত্র যেন হাঁ করে রয়েছে সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য। এখানে যে প্রশ্নটি প্রধান হয়ে ওঠে তা হলো: কেন? একটা স্বাধীন দেশে নারীদের অধিকার কী ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসবে কিছুসংখ্যক অশালীন মনোভাবপুষ্ট মানুষের জন্য? রুচির অভাবে, শিক্ষার অভাবে, আদর্শহীনতায়, নারীর প্রতি সম্মানের অভাবে একশ্রেণির পুরুষের মধ্যে বিকৃত খিদের সৃষ্টি হয় যা কোনো কিছুই তাদের প্রতিরোধ করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন অলস মানুষ ও যেখানে-সেখানে অকারণে অপেক্ষারত মানুষের ওপর শাসকশ্রেণির কড়া নজর রেখে নির্জন স্থানগুলোতে অনবরত পাহারা দেয়া। অলসতা ও বেকারত্ব মানুষকে সুস্থভাবে জীবনযাপনে অপারগ হয় বলে এর প্রতি বিধান ও প্রয়োজনীয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ-কাঠামোতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। এর সঙ্গে নারীদেরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। মানুষের বিকৃত মানসিকতা সৃষ্টি হলেই সমাজে নারী-পুরুষের জীবনে বিপদশংকুল দিকগুলো বড় হয়ে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা। সব রাস্তা নিরাপদ নয়, আবার কোনো কোনো শহরও নিরাপদ নাও হতে পারে। এর কারণ পুরুষের মধ্যে থেকে মধ্যযুগীয় বিকৃত মানসিকতা অনেক সময় সংরক্ষিত থাকে। ইংল্যান্ডের লন্ডন আর স্কটল্যান্ডের এডিনবরা শহরের মধ্যে তুলনা করলেই দুই ধরনের সমাজ-কাঠামো চোখে পড়বে। রাতের বেলায় লন্ডনের রাজপথ নিরাপদ নয় বলে নারীরা সাধারণত রাস্তায় নামেন না। অথচ এডিনবরার রাত্রিকালীন রাস্তা নারীদের পক্ষে একান্ত নিরাপদ। এ কারণে গভীর রাতে এখানে নারীরা একাকিনী পথে হেঁটে চললেও নিরাপদে আপন গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারেন। ঢাকায় নারীদের ওপর অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। থার্টিফার্স্ট নাইট বলে পরিচিত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে কয়েক বছর আগে এক নারীকে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। আর এবার ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা। এই ঘটনা শুধু দুঃখজনক নয়, দেশের সবাই লজ্জায় শুধু মাথা নত করেননি, বুকের ক্ষোভ বুকের ভেতরে রেখেই বুঝতে পেরেছেন এ দেশে কাঠামোগত অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু উন্নতি হয়নি নারীর নিরাপদ জীবনযাত্রা। মধ্যবিত্ত মানুষের গাড়ি কিনে যাতায়াতের ক্ষমতা নেই বলে, বাসে বা হেঁটেই গন্তব্যস্থলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। নারীর এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে যেসব পুরুষ তাদের সম্ভ্রমহানি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না তাদের এমন শাস্তি দেয়া উচিত যে, চিরজীবন নিজের কৃতকর্মের জন্য কাঁদতে কাঁদতে জীবন কাটায়। আজ এ দেশের মানুষের কামনা নিরাপদ সব পথে নারীরা যেন চলাচল করতে পারে, পুরুষের উগ্র জৈবিক বাসনার মৃতু্য হোক চিরতরে। ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক