নারী অবমাননা ও নির্যাতন

কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তি মানে ও বোঝে। মানুষের দুঃখ শোকে কাতর হন যিনি, সহমর্মিতা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নারী অবমাননাকারী নির্যাতক ধর্ষক বা হত্যাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিকতা সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নির্যাতন ধর্ষণ হত্যাকেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে।

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
নারীর অবমাননা বা নির্যাতন পরিবার ও সমাজে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে কোনো রকম প্রতিকারহীনভাবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির বিষয় স্পষ্ট দিক হলো- স্থানীয় প্রশাসন তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত ব্যর্থতা। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৪১৩ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ নারী এবং ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন। এ ছাড়া আরও এ বছর নারীদের উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানির ঘটনাও বেড়েছে। ২০১৯ সালে ২৫৮ জন নারী যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪৪ পুরুষ। উত্ত্যক্তের কারণে ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে চার নারীসহ ১৭ জন খুন হয়েছেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। উলেস্নখ্য, গ্রেপ্তার হওয়া মজনুর কাছ থেকে ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোন ও ভ্যানিটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। মজনু ১০ বছর আগে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে ভবঘুরে জীবনযাপন করত। সে মাদকাসক্ত ও 'সিরিয়াল ধর্ষক'। এর আগে ও প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুকদেরও ধর্ষণ করেছে। ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। নানা কর্মসূচিও পালিত হয়। ঢাবি শিক্ষার্থী ধর্ষণের প্রতিবাদে সমগ্র দেশ যখন উত্তাল ছিল ঠিক তখনই রাজধানীর অদূরে ধামরাইয়ে এক নারী শ্রমিককে বাসের মধ্যে ধর্ষণ শেষে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বাসচালকের বিরুদ্ধে। চলন্ত বাসে ধর্ষণ এক নতুন আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয়েছে। দুই বছর আগে টাঙ্গাইলের মধুপুরে যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে তরুণী রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। গত বছর কটিয়াদী উপজেলায় চলন্ত বাসে এক নার্সকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এর আগেও ধামরাইয়ে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে চলন্তবাসে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। চলন্ত বাসে ধর্ষণ এক কঠিন ও কুৎসিত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। প্রশ্ন উঠতে পারে, এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? অবাক ব্যাপার যে, যৌন নির্যাতন করছে কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা, ধনীর দুলাল। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, শিশু, যুবতী, আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। রাস্তা-ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, চলন্ত বাসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈশাচিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। আমাদের নারী, শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকারই কেবল হচ্ছে না, ধর্ষণের পর খুন হচ্ছে অবলীলায়। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ, অবমাননা এবং এর বিয়োগান্তক পরিণতি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। পৃথিবীব্যাপীই ঘটছে, তবে ইদানীং বাংলাদেশে যেন এর জোয়ার এসেছে। অপরাধীরা তো এ মানবসভ্যতারই অন্তর্গত, আমাদের চারপাশেরই বাসিন্দা। সবাই কোনো না কোনো পরিবারেই বেড়ে উঠেছে। সে পরিবার থেকে তারা কী শিক্ষা পেয়েছিল- এটাই আমাদের প্রশ্ন। আমাদের দেশেও নারী নির্যাতন রোধে আইন আছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। শুধু আইন তৈরি ও পাস নয়- সংশ্লিষ্ট মহলকে সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করা উচিত। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে- এ কথা প্রায় সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা যাচ্ছে না, তার কী হবে। সমাজে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ নারীরা। তাদের নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন করা হচ্ছে। ধর্ষণ-গণধর্ষণ করার পর তাদের হত্যা করা হচ্ছে। পরিবার মামলা করেও এর প্রতিকার পাচ্ছে না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বর্বর হচ্ছে শিশু ধর্ষণ ও হত্যা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সমাজ কি এভাবেই চলতে থাকবে, কোনো রকম প্রতিকারহীনভাবে? যে করেই হোক সমাজে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এর দায়িত্ব সরকারের। সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন হলে চলবে না। মনে রাখতে হবে নারী স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে সচেতন ও সোচ্চার হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। আসুন আমরা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের মাতা, ভগ্নি, স্ত্রী, কন্যাকে নরপিশাচদের হাত থেকে রক্ষা করি। যৌন নির্যাতন ধর্ষণ শুধু নারী, শিশুর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। মানুষের সম্মিলিত পদক্ষেপ আর সংগ্রামই পারে মানুষকে জাগাতে, নারীকে বাঁচাতে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্র আপসহীন না হলে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ না করলে সমাজের ভেতরে এই অবক্ষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে না। পরিবারের দায়িত্ব নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেবলই ভোগবাদী। তারা নারীকে সবসময় ভোগের বস্তু হিসেবেই গণ্য করে থাকে। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েই পরিবার ও সমাজের জন্য অনিবার্য। পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ, পরিকল্পনা, ত্যাগ ও সংযমের প্রয়োজন। একইভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্য উভয়েরই ভূমিকা ও অবদান সমভাবে প্রয়োজন। সে জন্য একজনকে উপেক্ষা করে বা বাদ দিয়ে কেবল পুরুষ কিংবা নারীর পক্ষে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। তাই আমরা চাই নারী-পুরুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সমঝোতামূলক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু আমাদের এ চাওয়ার সফল বাস্তবায়ন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কোথাও চোখে পড়ছে না। বরং প্রতিনিয়ত উল্টো ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে। পান থেকে চুন খসলেই আমরা নারীকে অপবাদ দিই। কথায় কথায় নারীকে কুলটা চরিত্রহীন ব্যভিচারী বলে আখ্যা দিই। নারীর দোষের অন্ত নেই। অন্যদিকে পুরুষরা শত অপরাধ করলেও তাদের চরিত্রে কোনো ধরনের কালিমা লিপ্ত হয় না। ভাবটা এমন যে পুরুষের 'চরিত্র' বলে কিছু নেই। এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিগত জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নারীর নয়- কেবলই পুরুষের। এটা যতদিন থাকবে ততদিন নারীর মুক্তি নেই, নারী স্বাধীনতার কথা বলে আমরা মুখে যতই ফেনা তুলি না কেন। মনে রাখতে হবে, নারী অবমাননা কিংবা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর সমাধানে কেবল আইন করলেই চলবে না, সবাইকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানের দরকার। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্র সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আশার বিষয় হলো- বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী সবাই নারী। এমনকি স্পিকারও নারী। তৈরি পোশাক খাতের ৮০ ভাগ শ্রমিকই এখন নারী। বাংলাদেশের নারীদের সমান অধিকার দিয়েছে সংবিধান। সেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক আইনগুলোতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। নারীরা যেন সুবিচার পান, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। তবে সংবিধান নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দিলেও অশিক্ষা, দারিদ্র্য বাংলাদেশের নারীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। এ দেশের সহিংসতার শিকার একটি মেয়েকে থানার পুলিশ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সংকট মোকাবিলা করতে হয়। পদে পদে সবাই বোঝানোর চেষ্টা করে যেন মেয়েটাই দায়ী। নারী অবমাননা কিংবা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে মেয়েটিকে কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ নেই। কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তি মানে ও বোঝে। মানুষের দুঃখ শোকে কাতর হন যিনি, সহমর্মিতা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নারী অবমাননাকারী নির্যাতক ধর্ষক বা হত্যাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিকতা সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নির্যাতন ধর্ষণ হত্যাকেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। \হতবে তার আগে প্রয়োজন দেশব্যাপী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, দারিদ্র্য বিমোচনে ও বেকারত্ব দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সবকিছু যদি সঠিক ও সমান্তরালভাবে চলে তবে সমাজ ও রাষ্ট্রও সঠিকভাবে চলবে। আর প্রতিদিন পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের ভয়াবহতা আমাদের প্রত্যক্ষ করা লাগবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। এটা যতদিন না হবে ততদিন পর্যন্ত নারী নির্যাতনের মাত্রা ও ভয়াবহতা কমবে না। আর এর জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, প্রতিবাদ সভা-পথসভার মাধ্যমে চিৎকার করেও কোনো ফল হবে না। নারী তো তার সামগ্রিকতা নিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। কিন্তু পুরুষকে তো তা গ্রহণ করার মানসিকতা, সাহস ও উদারতা অর্জন করতে হবে, হতে হবে উন্নত সাংস্কৃতিক ও রুচির অধিকারী। দায়িত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও এককভাবে পুরুষের। এ ব্যাপারে নারীরও করণীয় কম নয়। কারণ যিশুর ক্রুস যিশুকেই বহন করতে হয়েছে। স্বামী, অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনদের নারীর কর্তব্য কাজে উৎসাহ জোগাতে হবে। তাদের সফল উদ্যোগ ও চিন্তাকে স্বাগত জানিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করলে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের নারীদের আরও দীর্ঘ পিচ্ছিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক