পাঠক মত

কুয়াশায় কথন

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শীত কি কেবলি শীত? শীত মানেই তো সাত-সকালে পদস্পর্শে শিশিরসিক্ত ঘাসের আড়মোড়া ভাঙিয়ে সদ্য নামানো খেজুরের রসের হাঁড়ি সাবাড় করা। কিম্বা সকালের কাঁচা রোদে বসে নতুন গুড়ের চিতুই বা ভাপাপিঠা খেতে খেতে আয়েশি আলাপ। পুরনো চাদরটা গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে লাঙল-জোয়াল কাঁধে আলপথ ধরে হেঁটে চলেছে কৃষক। গৃহস্থ বাড়িতে দম ফেলার ফুসরত নেই, নতুন ধান ঘরে তোলার যে ভীষণ ব্যস্ততা! আত্মীয়-কুটুমরা সব নবান্নের নেমতন্নে আসবে, নতুন চালের পায়েস হবে, হবে দুধচিতুই বা দুধপুলি অথবা ক্ষীরের পাঠিসাপটা। আঙিনায় আলপনা আঁকে ঘোমটা টানা নববধূ। নদীর ধারের বড় বটগাছটার নিচে ফি-বছর মেলা বসবে, দুই গাছি কাঁচের চুড়ি কৃষাণির হাতের টুংটাং ধ্বনি তোলে অদ্ভুত দ্যোতনার সৃষ্টি করবে, মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা কিনে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে বাচ্চাগুলো ঘরে ফিরবে কিম্বা নাগরদোলা বা চরকিতে চড়ে টাকা কটা সেখানেই খোয়া যাবে, দুই টাকায় চারটে টেপাপুতুল জুটবে কেবল। সন্ধ্যে নামার আগেই রিক্ত প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়। অদ্ভুত নির্জনতা নেমে আসে, পায়ের নিচে ঝরাপাতার আর্তনাদ শোনা যায়। কোথাও কোথাও খড়ের আগুন জ্বেলে চারধারে ছেলে-বুড়ো সব জড়ো হয়ে বসে। রাতে পালাগান অথবা বাউলগানের আসর বসে। যাপিত-জীবনের ব্যস্ততা শেষে দু-দন্ড অবসরে আবালবৃদ্ধবনিতা মাঝরাত্তির অবধি জেগে শোনে 'মহুয়ার পালা' অথবা 'কমলার বনবাস'। মাঝেমধ্যে কেরোসিন কুপির সলতেটা একটু উস্কে দেয়, টিমটিমে আলো জ্বলে। শীত বলতেই কুয়াশায় মোড়া আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির এমনি একটা চেনা চিত্র মানসপটে ভেসে ওঠে। শহুরে নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতায় তা ক্রমেই হারাতে বসেছে বটে; কিন্তু গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের গ্রামীণ দৃশ্যটা ঠিক এমনি। তেমনি শীতের কুয়াশার আমেজে জাককানইবির কুয়াশা উৎসব। কুয়াশায় সু-আশায় কহ কুশলাদি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো উদযাপন হলো কুয়াশা উৎসব। শীতের কুয়াশার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির অকৃত্রিম মেলবন্ধনের রূপটিই কুয়াশা উৎসব। শীতের দীর্ঘ রাতগুলোতে অদ্ভুত সুন্দর কুয়াশায় নামে ক্যাম্পাসের বুকে, সোডিয়াম বাতির আবছা আলোয় স্বর্গীয় সৌন্দর্য ভর করে। সেই মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগের তরে এই আয়োজন। দুদিনব্যাপী উৎসবে ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রকলা প্রদর্শনী, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, ইন্সট্রুলেশন আর্ট, পারফরম্যান্স আর্ট। টঙ দোকানের চায়ের আড্ডাটায় বেশ জমিয়ে খোশগল্প। নতুন-পুরাতনের মেলবন্ধনে উৎসব আমেজে কুয়াশাচ্ছন্ন সময়টা কেটেছিল বেশ! আমাদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি তো তাই। এখানে সবাই আত্মার সম্পর্কের রঙিন সুতোয় বাঁধা পড়ে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকছে। শীতের নবান্নের আবহে এ পার্বণে যেন নতুন রঙের ছোঁয়া লাগে। প্রথমবারের মতো এমন একটি ব্যতিক্রমী রকমের উৎসব আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এবং শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ সবার সহযোগিতায় শীতের কুয়াশাকে উৎসবে পরিণত করার এমন অভিনব আয়োজন বছর বছর এমনি করেই উদযাপন হোক। বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য লালন করে কুয়াশা উৎসব রং ছড়িয়ে যাক জীবনে সবার। আরমান ঢাকা