লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার প্রধানত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ- তথা শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্ট আয়ের কর্মচারী প্রমুখ। মেহনতি মানুষের মজুরি বাড়ে না কৃষক ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পান না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতই বাড়তে থাকে, এমনকি লাফিয়ে লাফিয়েও। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা 'প্রকৃত আয়' কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যাতনা।

প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
বিদায়ী বছরে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে আগের বছরের মতোই ৬ শতাংশ। তবে ন্যায্যমূল্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ- যা আগের বছর বৃদ্ধি পেয়েছিল ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জীবনযাত্রার ব্যয় ও ভোক্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন-২০১৯ এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে চালের মূল্য ছিল সহনীয় ও নিম্নমুখী। তবে বছর শেষে চাল, আটা, ডিম, শাকসবজিসহ কিছু পণ্যের মূল্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী। পেঁয়াজ, এলাচ, রসুন ও আদা ছাড়া অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বহুলাংশে স্থিতিশীল ছিল। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রতিবেদন প্রকাশকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, কারা কারণে-অকারণে মূল্যবৃদ্ধি করছে তাদের খুঁজে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশে চালের দাম বাড়ছে আর কৃষক ধানের দাম পায় না, এমন অবস্থা অপ্রত্যাশিত। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের দিক তুলে ধরতে ভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানায় ক্যাব। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে পেঁয়াজ ছিল সর্বাধিক আলোচিত পণ্য। বছরের শুরুতে এর দাম ছিল প্রতি কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা। নভেম্বরে তা বেড়ে খুচরা বাজারে ২৫০ টাকা বা তারও বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। উৎপাদন মৌসুম শুরুর পরও ডিসেম্বরের শেষে পেঁয়াজের দাম ছিল ১০০ টাকার কাছাকাছি। ক্যাবের প্রতিবেদনে বিদায়ী বছরে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ছোটখাটো ত্রম্নটি বাদে তা বাস্তবের কাছাকাছি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছে নিম্নবিত্তের জনগোষ্ঠী। নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্যও টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশেষত রাজধানী ঢাকা দুনিয়ার অন্যতম বসবাসের অযোগ্য নগরী শুধু নয়, ব্যয়বহুল নগরীতেও পরিণত হচ্ছে। ঢাকায় ঘর ভাড়া, চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত ব্যয় সমমানের দেশগুলোর চেয়ে বেশি। চাল-সবজিসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও কৃষক তার সুফল পাচ্ছেন না বললেই চলে। বিশেষত ধান-চালের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক চাষাবাদে উৎসাহ হারাচ্ছেন। কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে বিরাট ফারাক রয়েছে এবং তা ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই এই অন্যায্য অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাল-ডাল-শাকসবজিসহ নিত্যপণ্য কিনতে। সরকার সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখতে কেউ যাতে অতি মুনাফার আশ্রয় না নেয়, সে বিষয়ে নজর দিতে পারে। পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধ করেও নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা জনগণের কাছে সরকারের সুকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সরকারের কাছ থেকে মানুষ যে দু'টি বিষয় প্রত্যাশা করে, তার একটি হলো আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ, অন্যটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ। এ ব্যাপারে সরকার তাদের সাধ্যের মধ্যে সব কিছু করবে, জনগণ এটাই দেখতে চায়। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পালস্না দিয়ে জীবন চালাতে গিয়ে সৎ ও সচ্ছল মানুষের জীবনে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন সীমিত থাকে, তেমনি জিনিসপত্রের বাজার দর দ্বারাও তা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিত্তবানদের জন্য দ্রব্যমূল্য প্রত্যক্ষভাবে কখনোই তেমন সমস্যা নয়। কারণ তাদের আয় প্রায় সীমাহীন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে আয় করে তা দিয়ে তাকে হিসাব করে চলতে হয়। মানুষের আয় যতটা বাড়ে সেই তুলনায় যদি জিনিসপত্রের দাম বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলেই তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্রয়ক্ষমতাই হলো তার 'প্রকৃত আয়'। 'প্রকৃত আয়' বৃদ্ধি না পেয়ে যদি একই জায়গায় স্থির থাকে তাহলেই শুরু হয় আশাভঙ্গের নিদারুণ যন্ত্রণা। আর 'প্রকৃত আয়' কমে গেলে যে যন্ত্রণা- তার মাত্রার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গণমানুষের আয়ের পরিমাণ ও বাজার দর- এ দুইয়ের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করাটাই হলো দ্রব্যমূল্য সমস্যা সমাধানের আসল উপায়। বাজার দর বৃদ্ধির তুলনায় আয় বাড়ল কি না, কিংবা উল্টো করে বললে, আয় বৃদ্ধির তুলনায় বাজার দর কম বাড়ল কি না- সেটিই দেখার বিষয়। চাল-ডাল- তেল-চিনির দাম যদি পাঁচগুণ বাড়ে তাতে মানুষের কোনো যন্ত্রণাই তেমন থাকবে না যদি তাদের সবার আয় পাঁচগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার প্রধানত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ- তথা শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্ট আয়ের কর্মচারী প্রমুখ। মেহনতি মানুষের মজুরি বাড়ে না, কৃষক ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পান না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতই বাড়তে থাকে, এমনকি লাফিয়ে লাফিয়েও। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা 'প্রকৃত আয়' কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যাতনা। 'প্রকৃত আয়' আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চলে যায় অনেক মাস- বছর। ততদিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তার 'প্রকৃত আয়'কে আবার পেছনে ফেলে দেয়। ফলে দ্রব্যমূল্যের যন্ত্রণা চলতে থাকে নিরন্তর। দ্রব্যমূল্যের 'পাগলা ঘোড়া'র যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য মানুষের 'প্রকৃত আয়ের' ধারাবাহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য একসঙ্গে নিতে হবে দুই দিক থেকে পদক্ষেপ। প্রথমত, ব্যাপক জনগণের ধারাবাহিক আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মূল্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন তা স্থিতিশীল থাকে কিংবা বৃদ্ধি পেলেও তা যেন কখনোই আয় বৃদ্ধির সাধারণ হারের ঊর্ধ্বে না ওঠে। আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ