দ্রব্যমূল্য, সাধারণ ভোক্তা ও অন্যান্য দিক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ

দেশে ফেরার পর মনটা খারাপ হয়ে যায় চারদিকে শকুনের প্রভাব দেখে। চারদিকে কিসের যেন একটা অভাব, তৈরি পোশাকের মতো মসৃণ আর আকর্ষণীয় নয়। মানুষ পেঁয়াজ কিনতে পারে না, অল্প করে আদা, রসুন কিনতে হয়, ধুলোর মধ্যদিয়ে চলতে হয়। রাস্তার চৌমাথায় গুটি কয়েক মানুষ অবরোধ করে চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয় নিজেদের ক্ষমতা বলে।

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নতুন বছরে মানুষ আগের বছরের শেষপ্রান্তে তাকালে খানিকটা মর্মাহত হয়ে যান। সংবাদপত্রেও নতুন বছরের প্রথম দিনে গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত দিক হিসেবে বড় করে পেঁয়াজের ছবি দিয়ে মানুষের দুর্ভোগের প্রতীকী দিক উপস্থাপন করেছে। সোনা নয়, রুপো নয়,পিতল হয়েও বাজারে পেঁয়াজ সোনার দামের মতো চড়া হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছিল, যে সংকট এখনো শেষ হয়নি। অনেক মানুষই উচ্চমূল্যের জন্য পেঁয়াজ কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাদের বাজাটের সঙ্গে পেঁয়াজের দাম খাপ খায় না বলে। যে পেঁয়াজ তিন-চার মাস আগেও পাঁচ কেজি ১২০ টাকায় পাওয়া যেত, সে পেঁয়াজ আকস্মিক আকাশচুম্বি হয়ে ১৮০ টাকায় এক কেজি বিক্রি হতে শুরু করে। বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কারণ-অকারণ দুটোই ক্রিয়াশীল ছিল। প্রথমত, গত বছর পেঁয়াজের ফলন আশানুরূপ হয়নি। দ্বিতীয়, পেঁয়াজ দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। তা সত্ত্বেও ভোক্তাদের কাছে একটা প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়ায় পেঁয়াজের অসংখ্য বস্তা বাজারে দৃশ্যমান হলেও আকস্মিক পেঁয়াজের দাম এত বৃদ্ধি হওয়ার নেপথ্য কারণ কী? বাজারে কোনো দ্রব্যের অস্বাভাবিক মুল্য বৃদ্ধি হলেই দায়ী করা হয় সিন্ডিকেটকে। এই সিন্ডিকেট কী, তাদের হাতে এমন ক্ষমতা কীভাবে আসে? সিন্ডিকেট অর্থে মজুদদার বা হোলসেল ব্যবসায়ী ধরলে সেখানেও একটা প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। সরকারের বর্তমানে তারা এমন ক্ষমতাধর কীভাবে হয়ে ওঠে? তাদের কী নিয়ন্ত্রণ করা যায় না? এক পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে যারা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে আর ভোক্তারা নীরবে অশ্রম্নপাত করে, তারা কি সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিধর? এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের দামের সঙ্গে ক্রমেই অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী থাকতে পারে? পেঁয়াজের দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আদা, রসুন, ডাল, চিনি, চালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে আগের চেয়ে বেশি। এখনো বাজারে আদা, রসুনের দাম কমেনি। ভোক্তাদের মধ্যে একটা প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাহলে কী ব্যবসায়ীরা সব ক্ষেত্রেই নিজেদের পুঁজি বৃদ্ধিতে অগ্রসর হতে পারে ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা ও বাজেটের দিক বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে। চরম আবহাওয়ার কারণে অনেক প্রয়োজনীয় পচনশীল সবজির দাম বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। বৃষ্টি ও শীতের কারণে বর্তমান বছরে (২০২০) বিভিন্ন ধরনের শাক, টমেটো থেকে শুরু করে অনেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে খানিকটা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। টমেটোর দাম ১০০ থেকে ৪০ টাকায় নেমে এসেছে। কাঁচা লংকাও বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। পুদিনাপাতা ও ধনেপাতা প্রথমে ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও বর্তমানে ৩০-৪০ টাকায় নেমে এসেছে। শুধু ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম আগের বছরের তুলনায় কমেনি শিশির ও বৃষ্টি কপি ফলনের ওপর আঘাত করার কারণে। বিভিন্ন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও বেঁধে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অধিদপ্তর পদক্ষেপ নিলে সাধারণ ভোক্তা অধিকারের ওপর কোনো প্রভাব রোধ করা সম্ভব। শুধু পণ্যদ্রব্য নয়, পাটকল শ্রমিকদের অভাব-অনটন ও অনশন, ইয়াবার দেশে প্রবেশও বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এর সঙ্গে অবশ্য বড় দিকও আছে। যেমন- আমেরিকার নেভাদার মতো জুয়ো খেলা, বিদেশে টাকা পাচার ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ। এক সময় বাংলাদেশের পাট সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত ছিল এবং এই পাট আমাদানির পর দেশের অর্থনীতিও খানিকটা শক্ত করেছিল। পাটের ব্যবসা এ দেশে নতুন নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশ ও তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সবচেয়ে ভালো গুণসম্পন্ন পাট উৎপাদন হতে শুরু করে এবং এই অঞ্চল পাট উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। নজিবর রহমান লিখিত আনোয়ারা উপন্যাসে তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের পরিবারও পাট ব্যবসায় অগ্রসর হয়েছিলেন। এই কারণেই কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জে দুটো বড় কুঠি নির্মিত হয়। এখনো কুষ্টিয়া শহরে ঠাকুর পরিবারে বিশাল আকারের পাটের গুদাম আছে। যে পাট এ দেশে বিরাট অর্থ এনে দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল আকারে আদমজি পাট মিল তৈরি হয়েছিল তা বন্ধ হয়ে যাওয়া, পাটকল শ্রমিকদের অনশন শুধু সোনালি আঁশের পতন নয়, অনেক মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে দারিদ্র্য। বাংলাদেশ যখন প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ওপরে উঠতে শুরু করেছে সে সময় ফেনসিডিল ইয়াবার দেশে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছেই ভারতে ফেনসিডিল তৈরির কারখানা আছে এবং সেখান থেকে অসংখ্য ফেনসিডিলের বোতল বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশে সীমান্তরক্ষীরা পাহারা দেওয়ার পরও কীভাবে মাদকদ্রব্য এ দেশে প্রবেশ করতে পারে? ফেনসিডিলের মতো অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনায় একদিকে বিপুল অর্থের অপচয় হয়। অন্যদিকে নেশাসক্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ফেনসিডিলের চেয়েও ইয়াবা দেশের মানুষের অনেক বেশি ক্ষতি করছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন দিক দিয়ে ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বিপুল সংখ্যক অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যায়। বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষের নেশাসক্তির কারণ কি? প্রাক-বাংলাদেশ আমলে ঢাকার ওষুধের দোকানে বিদেশ থেকে লাইসেন্স দিয়ে আনা হতো ওয়াইন কার্নিস ও ওয়াটারবেরি কম্পাউন্ড। ওয়াইন কার্নিসে অ্যালকোহলের পরিমাণ ছিল সত্তর ভাগের মতো। এই টনিক সাধারণভাবে প্রসূতিদের ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হলেও কোনোদিন কেউ নেশা করতে ভুলেও ওয়াইন কার্নিস ব্যবহার করতেন না। এ ছাড়া সাধনা ঔষধালয় ও অন্যান্য আয়ুর্বেদীয় ফার্মেসি টনিক হিসেবে বের করত মৃতসঞ্জীবনী সুরা। এখানে সামান্য সুরা মিশ্রিত থাকত বলে রিকশাওয়ালা বা একশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষ এই টনিক পান করে নিজেদের সাধ মেটাতো। আর অর্থবানরা ঢাকা এয়ারপোর্ট (পুরনো) ও কয়েকটা হোটেলে গিয়ে মদ্যপান করতেন। এসব হোটেলের পারমিশন ছিল মদ বিক্রির। পুরনো ফুলবাড়িয়া স্টেশনের শেষপ্রান্তেও একটা রেস্তোরাঁয় মদ্যপানের ব্যবস্থা ছিল এবং কিছুসংখ্যক ফুটবল খেলোয়াড় এখানে আড্ডা দিতে আসতেন। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রধান হয়ে ওঠে, প্রাক-বাংলাদেশ আমলে সাধারণের মধ্যে চোরাকারবারির মাধ্যমে ফেনসিডিল ও ইয়াবা এনে অসংখ্য মানুষের মধ্যে নেশার অভ্যাস ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী হতে পারে। এর একাধিক উত্তর থাকতে পারে। অসৎপথে অর্থ উপার্জন, মাদক অভ্যাস বিস্তৃতির ফলে সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করা ও একশ্রেণির আদর্শহীন মানুষের জন্ম দেওয়া। সরকারের কোষাগারে অর্থ জমা হওয়ার পরিবর্তে অসংখ্য ব্যক্তির পকেট ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সমাজে বিশৃঙ্খলাকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়া। বাংলাদেশের রাস্তার বেহাল অবস্থা, ভাঙা সেতু, বায়ুদূষণের মতো অনেক খারাপ পরিবেশ নিয়ে বসবাস করলেও গার্মেন্টের কল্যাণে পৃথিবীর শপিং মার্টে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। লন্ডনের মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের মতো বিপণি বিতানেও এখন শোভা পায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। ঢাকায় মার্কস ও স্পেন্সারের প্রতিনিধি, যিনি দোকানের চাহিদা মতো জিনিস তৈরি করে সরবরাহ করেন, তিনি আগের চেয়েও সচেতন বলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শপিং মার্টে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের দোকানে বাংলাদেশের দ্রব্যের চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ভারতেও এই দোকানে বাংলাদেশের দোকানে দ্রব্য থরে থরে সাজানো। এখানে সবচেয়ে ভালো গেঞ্জি বাংলাদেশের। এত মসৃণ ও স্ট্রেচেপল গেঞ্জি জকিও তৈরি করে না। দুটো গেঞ্জির দাম ১৫০০ রুপি, আবার অন্য শ্রেণির তিনটে গেঞ্জিও এক হাজার রুপিতে পাওয়া যায়। দুবাইয়ের সবচেয়ে বড় শপিং মার্টে সুতোর তৈরি বাংলাদেশের সোয়েটার ক্রেতাদের কাছে বেশ প্রিয়। কানাডায় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে এ দেশের তৈরি আকর্ষণীয় ও ভালো শার্ট সহজেই নিজের স্থান করে নিয়েছে। ইরানেও এ দেশের শার্টের ব্যাপক চাহিদা। বাংলাদেশের বাইরে বেড়াতে গেলে নিজের দেশের জিনিস দেখে গর্বে বুক ভরে ওঠে। দ্রব্যের গায়ে হাত দিয়ে মনে পড়ে এই আমাদের সোনার দেশের তৈরি, ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য দেশে। দেশে ফেরার পর মনটা খারাপ হয়ে যায় চারদিকে শকুনের প্রভাব দেখে। চারদিকে কিসের যেন একটা অভাব, তৈরি পোশাকের মতো মসৃণ আর আকর্ষণীয় নয়। মানুষ পেঁয়াজ কিনতে পারে না, অল্প করে আদা, রসুন কিনতে হয়, ধুলোর মধ্যদিয়ে চলতে হয়। রাস্তার চৌমাথায় গুটি কয়েক মানুষ অবরোধ করে চারপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয় নিজেদের ক্ষমতা বলে। তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় খোলা রাস্তার জন্য। বিভিন্ন রাস্তার ওপরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে, বাস যে এখানে কখন আসবে তা কারোর জানা নেই। যে দেশের পণ্য তৈরি হয় শৃঙ্খলার সঙ্গে, সে দেশে কী এমন শৃঙ্খলা আনা কঠিন? না, শুধু প্রয়োজন যে কোনো অরাজক অবস্থা বা পরিস্থিতি দমন করা। এমন দেশ কবে অহংকারের দেশ হয়ে উঠবে আমাদের সবার কাছে। দেশের মানুষ উজ্জ্বল দৃষ্টিতে বলতে পারবে সোনার পণ্যের মতো এই আমাদের সোনার দেশ- বাংলাদেশ। ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক