বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা

তারুণ্যের শক্তি বা কর্মদক্ষতার ওপর একটি দেশ উন্নতি লাভ করে। দুঃখের বিষয় হলো, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মর্মপীড়া কাজ করছে। একাডেমিক পড়া শেষ করে চাকরির পড়া শুরু করার স্বল্পসময়ের মধ্যে বয়স ৩০ পার হয়ে যাচ্ছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স দ্রম্নত শেষ হওয়ার কারণে হাজার হাজার তরুণ আর চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না!
সাধন সরকার
  ২২ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। যদিও তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চললো। গড় আয়ু এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গড় আয়ু ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বিআইডিএসে'র সম্প্রতি এক গবেষণা বলছে, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। গবেষণায় বলা হয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বৈশ্বিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট' কয়েক বছর আগে বলেছিল, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সর্ব্বোচ। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জরিপ মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার প্রায় ৫ ভাগ। যদিও শিক্ষিত বেকারের হার এ দেশে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় সর্ব্বোচ। চিন্তা করা যায়, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে যদি এক-তৃতীয়াংশ বেকার থাকে তাহলে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে চাকরির বাজারের কতটুকু সমন্বয় রয়েছে? একটি শূন্য পদের বিপরীতে এ দেশে এখন শত শত প্রার্থী আবেদন করে। এ থেকে বোঝা যায় চাকরির বাজারে তরুণরা কতটা অসহায়! এ দেশে শিক্ষার সঙ্গে চাকরির মিল খুব কমই। পড়ালেখা শেষ করে আলাদাভাবে চাকরির প্রস্তুতি নিতে হয় প্রত্যেক তরুণদের। এ দেশে পড়ালেখা শেষ করে কাঙ্ক্ষিত চাকরির জন্য আলাদাভাবে শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করা লাগে। তারপরও চাকরি নামের 'সোনার হরিণ' কপালে জুটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! গত প্রায় ১০ বছর ধরে তরুণ সমাজ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর ব্যাপারে দাবি জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে যোগদানের বয়স যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়ানোর আশ্বাসসহ জাতীয় সংসদে এ ব্যাপারে কয়েকবার আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু সময়ের এই যৌক্তিক দাবিটি নিয়ে এখনো তরুণদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে, অনশন করতে হচ্ছে।

তারুণ্যের শক্তি বা কর্মদক্ষতার ওপর একটি দেশ উন্নতি লাভ করে। দুঃখের বিষয় হলো, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মর্মপীড়া কাজ করছে। একাডেমিক পড়া শেষ করে চাকরির পড়া শুরু করার স্বল্পসময়ের মধ্যে বয়স ৩০ পার হয়ে যাচ্ছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স দ্রম্নত শেষ হওয়ার কারণে হাজার হাজার তরুণ আর চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না!

সদ্য চাকরির বয়স পার হওয়া লাখ লাখ তরুণের প্রাণ গুমরে গুমরে কাঁদছে! প্রত্যেক বছর গেল বছরের চেয়ে আরও বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সত্যি বলতে, মানসম্মত চাকরি পেতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে করতে প্রায় ২৫-২৬ বছর লেগে যাচ্ছে! চাহিদা ও বাস্তবতা বিবেচনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরির বয়স বেড়েছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, এ দেশে বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই! ঘুষ-দুর্নীতির কারণে অনেকে আবার সময়মতো চাকরি পাচ্ছে না! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে যেন অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা '৩০' এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? দেশের সব তরুণের সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। চলতি বছর মুজিববর্ষ। এই মুজিববর্ষে তরুণ সমাজের যৌক্তিক ও সময়ের দাবি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ুক। বেশি সময় ধরে চাকরির পড়াশোনার প্রস্তুতি গ্রহণ ও বেকারত্ব দূর করতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করা হোক।

বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বরং সব পর্যায়ের তারুণ্যের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধাসমূহ হলো- ১. সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে। ২. উন্নত দেশসমূহের সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ৩. শিক্ষিত বেকারের হার কমবে। ৪. রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে। ৫. দেশের মেধা বিদেশে চলে যাবে না, অর্থাৎ মেধা পাচার বন্ধ হবে। ৬. কাজ পেলে তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। ৭. রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশি সময় পাবে। ৮. তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। ৯. গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ১০. বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে। ১১. একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রশিক্ষিত করে শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং ১২. সর্বোপরি তরুণ জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে।

সাধন সরকার: কলাম লেখক ও পরিবেশ কর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85385 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1