ধর্ষণ ও অপরাধ

নতুন আইনের চেয়ে বিদ্যমান আইনের আওতায় এনে এই অপরাধগুলোর বিচারটা দ্রম্নত করাই জরুরি। আর তা করতে না পারলে ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধ ক্রমাগত হারে বাড়বে।

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বেশ কিছুদিন উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের কাছে ধর্ষিত হয়। এর প্রতিবাদে সারাদেশব্যাপী মানববন্ধন ও মৌন মিছিলসহ নানা ধরনের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল দেশের শিক্ষার্থীসহ সুধীজনরা। ওই শিক্ষার্থী বাস থেকে নামার পর ধর্ষক তার মুখ চেপে ধরে, তারপর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অজ্ঞান অবস্থায় শিক্ষার্থীকে ধর্ষক নিয়ে যায় বিমানবন্দর সড়কের পাশে নির্জন স্থানে, সেখানেই শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হন। আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় এবং অক্লান্ত শ্রমে অবশেষে ধর্ষক মজনু গ্রেপ্তার হয়। ধর্ষক মজনু গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে আরো কিছু অপরাধের কাহিনী। এলিট ফোর্সর্ যাব গণমাধ্যমকে জানায়, ধর্ষক মজনু একজন সিরিয়ালর্ যাপিস্ট। মজনুর ধর্ষণের শিকার ছিন্নমূল নারী ও কিশোরীরা (যারা ফুটপাতে রাতযাপন করে)। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে যা জানা গেছে, এই মজনুর ধর্ষণের হাত থেকে বাকপ্রতিবন্ধীরাও বাদ যায়নি। মজনুর বয়স (গণমাধ্যম থেকে জানা) ৩০ বছর। সে ভবঘুরের ভাব ধরে থাকে। মজনু নেশায়ও আসক্ত। মজনুর কাছে পথে রাতযাপনকারী গৃহহীন কতজন নারী ধর্ষিতা হয়েছে তা কেউ জানে না। দেশের নারীরা এ রকম ধর্ষণের শিকার হলে তার কোনো বিচার চাওয়ারও পথ নেই, (কারণ মজনু গ্রেপ্তারের পর ঢাকার ফুটপাতে অবস্থানকারী নারীদের যৌন হয়রানির চিত্রটা ফুটে উঠে), এ ধরনের ফুটপাতে রাতযাপনকারীদের যৌন হয়রানি হওয়ার হিসাবটা কেউ জানে না। যদি ধর্ষণের ঘটনাটি জানাজানি হতো তাহলে ঊীঃৎবসব ঝড়পরধষষু বীপষঁফবফ এ ধরনের নারীরাও (ধর্ষিতারাও) নায্য বিচার পেত। বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মজনুর মতো ধর্ষকরা এ রকম ঊীঃৎবসব ঝড়পরধষষু বীপষঁফবফ নারীদের ধর্ষণ যে কত করেছে আর সেই ধর্ষিতারা শুধু গোপনে আর্তনাদ করেই বেড়িয়েছে। ধর্ষণের মতো অপরাধ বাংলাদেশে প্রতিদিন বাড়ছে। গত দুই বছর আগের তথ্যে জানা গিয়েছিল যে, সেই সময় এক বছরে ধর্ষণের শিকার হয় ১২৫১ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি থেকে এই গণমাধ্যম তথ্যটি প্রকাশ করেছিল। বিষয়টি হলো, যে সব ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে আসে বা মামলা হয় তার ভিত্তিতে এ সংখ্যাটি নির্ণীত, সুতরাং ছিন্নমূল ভিক্ষুক গৃহিণী রাস্তায় রাতযাপনকারী নারী বা কিশোরীরা যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার সংখ্যা কিন্তু জানা যায়নি (ধর্ষক মজনু গ্রেপ্তার হওয়ার পর যে সব খবর প্রকাশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা)। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা পাঁচশর মতো উপজেলা শহর, তার বাইরে রয়েছে পৌরসভা; বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে এ ধরনের জায়গায় অসংখ্য ছিন্নমূল পরিবার বসবাস করে খোলা আকাশের নিচে। এই পরিবারগুলোও নানাভাবে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয়। এদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টি তেমনভাবে সমাজকে আলোড়িত করে না তাই এদের যৌন হয়রানির বিষয়টি অনেক সময় আইনের আওতায়ও আসে না (এরা নিজেরাই বিপদে পড়বে মুখ খুললে এ রকম ভয়ের কারণও অনেক সময় আইনের আশ্রয় তারা নেয় না), তাই দেশব্যাপী পরিসংখ্যানগত সংখ্যায় এদের যৌন হয়রানির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয় না। এতে বোঝা যায়, প্রতিবছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ধর্ষণের যে সংখ্যাটি প্রকাশ পায় তার চেয়ে অনেক বেশি নারী এ দেশে ধর্ষণের শিকার হয়। এ ধরনের ধর্ষণের শিকার ক্রমাগতভাবে বাড়লে বাংলাদেশও একদিন আমেরিকার মতো ধর্ষণের তালিকার প্রথম কাতারে চলে আসতে পারে। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয় আমেরিকায়। বাংলাদেশের ধর্ষণনিরোধকল্পে বিজ্ঞজনরা নানা ধরনের উপদেশ দিচ্ছেন। ধর্ষণের শাস্তি মৃতু্যদন্ড বিধানের জন্য সোচ্চার প্রতিবাদকারীরা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ পর্যন্ত আলোচিত এবং হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ করা কতগুলো ধর্ষণের বিচার হয়েছে? তার সঠিক পরিসংখ্যনটিই বা কোথায়। নুসরাত হত্যার বিচার হয়েছে দ্রম্নত এ কথা ঠিক- কিন্তু তনু। ২০১৬ সালে সারাদেশ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল তনু হত্যার প্রতিবাদে। তনু হত্যার বিচারের রায় কি কার্যকর হয়েছে। তনু হত্যার বিষয়টি হৃদয় বিদারক, দুইবার তনুর লাশ ময়নাতদন্ত হয়। আর এ তদন্ত বিষয়টি যেভাবে গণমাধ্যমে আসে তা হয়ে উঠে মুখরোচক গল্পের মতো, ২০১৬ সালের ১৩ জুনের দৈনিক সংবাদের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাংবাদিকরা মেডিকেল বোর্ডকে প্রশ্ন করেছিল, মৃতু্যর আগে তনু ধর্ষিতা হয়েছিল কি না? এই প্রশ্নটির জবাব মেডিকেল বোর্ড উত্তর দিয়েছিল এভাবে- তা ছিল, ধর্ষণ হচ্ছে একটি লিগ্যাল টার্ম, এটা সায়েন্টিফিক টার্ম না। যৌনাঙ্গে স্পর্শ লাগলেই ধর্ষণ হয়। এটা লিগ্যাল টার্ম সায়েন্টিফিক না, কিন্তু মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য ডা. ওমর ফারুক যা বলেছিলেন তা হয়তো লিগ্যাল না হয়ে সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা হতে পারে। তিনি বলেছেন, সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্স আর ধর্ষণ দুইটি ভিন্ন বিষয়, তবে তনুর মৃতু্যর আগে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স হয়েছে তবে কতক্ষণ আগে হয়েছে তা বলা যাবে না। মৃতু্যর আগে যে যৌনক্রিয়া হয়েছে ডা. ওমর ফারুক তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তনুর যৌনক্রিয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। এখানে প্রশ্ন আসে, অভিজ্ঞ কোনো নারীকে ধর্ষণ করা কি অপরাধ হবে না? যদি ময়নাতদন্তে তনুর যৌন অভিজ্ঞতা প্রমাণ করা যায়, তা ছাড়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, মৃতু্যর আগে তনু সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করেছে, তাহলে এই ইন্টারকোর্সটি ধর্ষণ তো হতে পারে না কেন? মেডিকেল ফরেনসনিক টিমের বক্তব্যে কি বৈপরীত্যের সুর বুঝা গিয়েছিল সেই সময়। বিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখায় আসলে ফরেনসনিক টিম বা মেডিকেল টিম কি বুঝাতে চেয়েছেন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতায় আসবে না। বিষয়টা হলো ডাক্তারি পরীক্ষার বৈজ্ঞানিকভিত্তির ওপর মন্তব্য করা ঠিক না। তবে ফরেনসনিক মেডিকেল টিমের সদস্য মৃত তনু সম্পর্কে যা বলে ছিলেন তাতে তনু হত্যাকান্ডের রহস্য আরো ঘনীভূত করার মতো। ফরেনসনিক টিমের সদস্যের বক্তব্যের মাধ্যমে তনুর বিষয়ে অন্য আরেকটা নতুন দিক প্রকাশিত হলে কাউকে দোষারোপ করা যেত না। তনুকে হত্যা করা হয়েছে এটা তো সত্য। কারা তনুকে হত্যা করল এই রহস্য উন্মোচন করাটাই ছিল সেই সময় বেশি জরুরি? কিন্তু তা করা হয়নি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারীকে যে কোনোভাবে অপরাধী বানানো যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তনু হত্যাকান্ডের বিষয়ে যে সব তথ্য এসেছে তা তনুকেই অপরাধী করার একটা অপচেষ্টা ছিল। তনুর ধর্ষক বা ঘাতক সম্পর্কিত কোনো প্রকার তথ্য গণমাধ্যমে আসেনি। দেশের শান্তিশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ডিটেক্টিভরা শুধু তনুর বিষয়ে জানাতে পারলেন, ঘাতকের বিষয়ে নয় কেন? তনু হত্যাকান্ড সম্পর্কে যে রসালোভাবে সংবাদটি গণমাধ্যমে এসেছিল তা তনুর হত্যা বিচারের চাইতে তনুর চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। নারীর শ্লীলতা হানি ধর্ষণসহ নানা ঘটনার তদন্তের বর্ণনা এমনভাবে বিশ্লেষণ করে গণমাধ্যমে আসে তাতে নারীর আর সম্ভ্রম থাকে না। তাই দেখা যায়, সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে নির্যাতিত নারীরা আইনের আশ্রয় নিতেও ভয় পায়। আর ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়ছে এভাবে। বছরের পর বছর যদি কোনো অপরাধের বিচার নিষ্পত্তি না হয় তাহলে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের পর ঢাকায় আরো দুইটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তারমধ্যে একটি কিশোরী ধর্ষণ। প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হয়। কেন ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়ছে সে বিষয়ে গবেষণা করা দরকার। এ দেশে যৌন শিক্ষার রয়েছে অভাব। বয়সন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের যৌনবিষয়ক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। যৌন শিক্ষা সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে যৌন সংক্রান্ত অপরাধ এবং যৌন রোগও ছড়ায়। তা ছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ধর্ষণ বা হত্যাকান্ড যেগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক বা গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করে, সেই অপরাধগুলোর অপরাধী ধরতে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠে। এ দেশের ছিন্নমূল নারীদের প্রতি যে ব্যভিচার হচ্ছে তা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমে তেমন একটা আসে না। ফলে এদের ওপর সংঘটিত অপরাধ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায় না। বছরের পর বছর অনেক ঘটনার বিচার হয় না। তাই অপরাধ বেড়েই চলছে। নতুন আইনের চেয়ে বিদ্যমান আইনের আওতায় এনে এই অপরাধগুলোর বিচারটা দ্রম্নত করাই জরুরি। আর তা করতে না পারলে ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধ ক্রমাগত হারে বাড়বে। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক