সামাজিক ব্যাধি

প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক প্রাবন্ধিক
ধর্ষণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সমাজে। ধর্ষণ পর হত্যার লোমহর্ষক সব ঘটনায় আঁতকে উঠছে দেশবাসী। এই ন্যক্কারজনক ঘটনা গ্রামে-শহরে, বাড়িতে কিংবা রাস্তায়, অফিসে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনকি চলন্ত বাসেও হচ্ছে। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুলছাত্রী থেকে পোশাককর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমনকি ভিখারিনীও রেহাই পাচ্ছে না হিংস্র থাবা থেকে। প্রতিদিনই মাত্রাতিরিক্ত হারে অসংখ্য শিশু এবং নারী ধর্ষিত হচ্ছে। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। যা এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক কাঠামো ধ্বংস হওয়া নিশ্চিত। ধর্ষণ মূলত এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। অসুস্থ মানসিকতার লোক এ পথ বেছে নেয়। বর্তমান আধুনিক সমাজব্যবস্থা ও ডিজিটাল প্রবণতায় যারা নারীকে যোগ্য সম্মান মর্যাদা দিতে প্রস্তুত নয়, তারাই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধ করে থাকে। ধর্ষণে শিকার হয়ে অসংখ্য নারী আত্মহত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেন না। ধর্ষণে শিকার নারীই সামাজিক ক্ষেত্রে লাঞ্ছিত বঞ্চিত হন। ধর্ষণের ফলে নারীর সুন্দর স্বপ্ন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দেয়। আর সেই ধ্বংসযজ্ঞে পুড়তে থাকে সে নিজে ও পরিবার। বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন, কেন ধর্ষণ হচ্ছে? অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সমাজ পরিবর্তন, পারিবারিক অবহেলা, অপসংস্কৃতি, ভুল শিক্ষা, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা, সামাজিক বৈষম্য, ব্যক্তিত্বহীনতা, বেকারত্ব ইত্যাদি ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ। তা ছাড়া পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের ক্ষতিকারক প্রভাবে ধর্ষণপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, ইন্টারনেট, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, বস্নগ, ইউটিউব, টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে যৌন উত্তেজনাপূর্ণ ছবি দেখে অনেকে লালসা চরিতার্থের পথ খুঁজে ফেরে ও যা দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সামাজিক অবক্ষয়, মাদক বিস্তার, কর্মহীনতা, সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নো ছবির অবাধ বিক্রি, সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রমান্বয়ে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। যা মারাত্মক ব্যাধি আকারে রূপ নিচ্ছে। অথচ দেশে এ সংক্রান্ত আইন নেই তা বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড আর ধর্ষণের কারণে মৃতু্য হলে তাতে মৃতু্যদন্ডের বিধানও রয়েছে এবং কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানা হবে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের তুলনায় আমাদের দেশের আইন অনেক কঠোর। ইতোমধ্যে আইন অনুযায়ী রায় কার্যকর হয়েছে, তা সত্ত্বেও দুর্বৃত্তরা এ ধরনের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় যথাযথ জ্ঞানচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। অসচেতনতার ফলে বাড়ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ধর্ষণের মতো ঘটনা বেশি ঘটে। এসব পরিবারে নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে থাকে। এর সুযোগ নেয় স্বার্থসন্ধানী লোক। সুযোগ বুঝে এসব পরিবারের শিশুদের নিজের কাছে নেয় এবং অবুঝ শিশুরা তাদের লালসার শিকার হয়। বর্তমানে যেভাবে শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন আতঙ্কিত করে তুলেছে। সমাজ কলুষমুক্ত করতে হলে সব অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে পঙ্কিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাবে সমাজ। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে বেশির ভাগ নারীই বিচার চাইতে যান না। আবার যেসব নারী বিচার চাইতে যান, তাদের পুলিশ, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়। ধর্ষণের অভিযোগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয় না। ধর্ষণ রোধে চাই সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ। ধর্ষণকারীর বিচার হতে হবে দ্রম্নত ও দৃষ্টান্তমূলক। যাতে অন্য কোনো ধর্ষণকারী ধর্ষণ করতে হাজারবার চিন্তা করে। ধর্ষণ শুধু একটি ব্যাধি নয়। দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপ। এই অভিশাপের কালো অধ্যায় থেকে সমাজকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশু নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দান ও মৌলিক অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ব। ভবিষ্যতের কান্ডারি শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির বিকল্প নেই। এ শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান তার পরিবার। আচরণ, মূল্যবোধ, ধারণা, বিশ্বাস, নৈতিকতা, সাহস, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয় তার পরিবার। এটাই তার সারা জীবনের আচরণের মূল চাবিকাঠি। সন্তানকে পারিবারিকভাবে সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা দেয়া হলে সেই সন্তান কখনো বিপথগামী হবে না। পরিবারে যা শিখবে, সারাজীবন সে তাই করবে। পরিবারে সে ভালো কিছু শিখলে ভালো হবে, না হলে সে হবে খারাপ। তাই সব শিশুকে ছোটবেলা থেকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং সেই জ্ঞান অনুযায়ী জীবন প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে কখনো শিশুরা কোনো অন্যায় মেনে নেবে না। সত্য ছাড়া অন্য কিছুতে ভয় পাবে না, কিছু গোপন করবে না, তারা সাহসী হবে, কোনো অন্যায় দেখলে শুরুতেই প্রতিবাদ করতে শিখবে। বাংলাদেশ জনবহুল একটি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের কোথায় কী ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর পক্ষে সব খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ধর্ষণ ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে জাতিকে নৈতিকতাসমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। জোর দিয়েই বলতে চাই, দেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সমাজবিশারদ, রাজনৈতিক নেতারা সবাই এক হয়ে ধর্ষণপ্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে নিরাময়ের উপায় বের করতে হবে। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ যে মাত্রায় বেড়েছে, তা লাগাম টেনে না ধরা গেলে সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে। শিশু অধিকার দপ্তরের তথ্যানুযায়ী- ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে শিশু ধর্ষণের শিকার ৪৯৬ জন। ২০১৮-এর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৫১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে দুই মাসে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২১৪ জন। বাকি চার মাসে শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ২৮২ জন। প্রতি মাসের গড় হিসাব প্রায় ৮৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৫৭১ জন। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে শতকরা ৪১ শতাংশ যা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন আশঙ্কাজনক। ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে ধর্ষণ হওয়া এই ৪৯৬ জন শিশুর মধ্যে গণধর্ষণ স্বীকার ৫৩ জন শিশু এবং ২৭ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে এ ছাড়া ধর্ষণ পরে হত্যা করা হয়েছে ২৩ জন শিশুকে। এমনকি এই ৬ মাসে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৭৪ জন শিশুকে। ২০১৯ সালের শিশু ধর্ষণের ঘটনা অতীতের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। শিশু অধিকার দপ্তরের তথ্যানুযায়ী- ধর্ষণের সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। তাই এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই মনে করে সংস্থাটি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী- ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া বেশির ভাগ শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি যৌন নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষকের দ্বারা নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১২৯ জন। এদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী- ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন নারী ও শিশু। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৪২ জন। এরমধ্যে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় নারী ও শিশুসহ ৬৩ জন। ২০১৮ সালে যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে তার চেয়ে ২০১৯ সালের অর্ধেক সময়ে ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী- ২০১৭ সালের প্রথম আট মাসে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ১৯৪৪টি, শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৫২টি। ২০১৬ সালে ধর্ষণ মামলা হয় ৬০১টি, ২০১৫ সালে ৫২১টি, ২০১৪ সালে ১৯৯টি, ২০১৩ সালে ১৭০টি এবং ২০১২ সালে ৮৬টি। সমাজ থেকে ধর্ষণ নামক ব্যাধি দূর করতে সবার আগে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন ও বৈষম্য দূর করতে হবে। দুর্বল ভিকটিমদের পক্ষে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। অপরাধ তদন্তে ও অপরাধীদের আইন আমলে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরপেক্ষ ভূমিকা ও সঠিক তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। কেননা বেকারত্ব সমস্যার কারণে ধর্ষণের প্রবণতা ব্যাপক আকারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন শিক্ষিত চাকরিজীবী ছেলে কখনো এমন জঘন্য কার্যকলাপে নিজেকে জড়াতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধর্ষণ নামক ব্যাধি আমাদের সমাজ থেকে নিশ্ছিন্ন হবে বলে মনে করি।