মাটির টানে ফিরে চলা

কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো, কী অঁাচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর ক‚লে ক‚লে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদÐ শান্তির’ জন্য এই যাত্রা?

প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

ড. হারুন রশীদ
২২ আগস্ট পালিত হবে ঈদুল আজহা। বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যের সন্ধানে যেমন শহরে পাড়ি জমায় তেমনি আবার উৎসবে আনন্দে গ্রামে যায়। বিশেষ করে দুই ঈদে মানুষের প্রিয়জনের সান্নিধ্যে যাওয়ার সেকি প্রাণান্তকর চেষ্টা। মওকা বুঝে বাস মালিকদের ভাড়া বৃদ্ধি, রেলের টিকিটের জন্য রাতভর অপেক্ষা, সড়ক-মহাসড়কে দীঘর্ যানজট ইত্যাকার কষ্টকর নানা সমস্যা উজিয়ে ঘরে ফেরার আনন্দই হয়ে ওঠে মুখ্য। ঠঁাই নেই, তবুও যেতে হবে। বাসে, ট্রেনের কামরায় ভেতরে দঁাড়িয়ে, সেখানে জায়গা না হলে ছাদে। লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে, ডেকে দঁাড়িয়ে এমনকি ছাদের ওপর বিছানা পেতে সেখানেই গন্তব্যের জন্য বসে পড়া। ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর একই অবস্থা হয়। যেভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতেই হবে। এ টান যে বড় বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছোটে প্রাণের টানে, শেকড়ের সন্ধানে? কীসের এত মায়া? কীসের জন্য মানুষের এই ঘরে ফেরার আকুতি? সেকি কেবলই প্রিয়জনের সান্নিধ্য? নাকি তারও অতিরিক্ত অন্যকিছু? কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো, কী অঁাচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর ক‚লে ক‚লে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদÐ শান্তির’ জন্য এই যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে গ্রামেই। বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়তো অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা, ভাত-কাপড়, রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ, বিলাস, আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না? এই শহরে তো দিগন্তবিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার-ভাটায় দুলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের ক্ষেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাশের বঁাশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারি সারি, ভাটিয়ালির হৃদয় উদাস করা সুর নেই, বঁাশ বাগানের মাথার ওপর চঁাদ নেই। নেই এক চিলতে উঠোন । এসব নেই-এর পাল্লা এতটাই ভারী যে তা মেপে শেষ করার নয়। সে জন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হঁাটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কী আর এত হিসেব-নিকেষ করে চলে। কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম, কোথাও ঘুরে এলামÑএই রকম তো। আটপৌরে বাঙালি। কোথায় আর যাবে। বেড়ানোর কী ফুরসত আছে? যে মাইনে আর রোজগার তাতে সংসারের হঁাড়ি টানতেই তো সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতেই তো হিমশিম খেতে হয়। সে জন্য বিদেশ বিভূঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজগ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে? নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুৎ পেঁৗছেছে বেশির ভাগ গ্রামেই। বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। কম্পিউটার, সঙ্গে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সংযোগ। মফস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে সংবাদ পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটে ই-মেইলের মাধ্যমে অতিদ্রæত তারা পাঠিয়ে দেন খবরাখবর। ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। মৎস্যচাষি, পোল্ট্রি ফামের্র মালিক, কিংবা সবজিচাষি মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজারদর যাচ্ছে ঢাকায়। এভাবে ভাচুর্য়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? এর জন্য তো আসল দুধই চাই। আর সেটি পেতে হলে তো ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনো আশানুরূপ নয়। এ জন্য ঘরমুখো মানুষজনের দুভোের্গর সীমা নেই। কিন্তু তাতে কি? যেতে তো হবেই। শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, ছোট্ট বেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠো পথের স্মৃতি, হাডুডু আর ফুটবল খেলার মাঠ, কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে। সাপের ফণার মতো বেণি দোলানো পাশের বাড়ির দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে এই শহরে। এই শহরে নিভের্জাল জীবনানন্দ কোথায়? এখানে তো মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির মধ্যে বাস। জীবন কোথায় এখানে? চারিদিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান, পাটির্, মলম পাটির্। (রাজনৈতিক দলগুলোও তো পাটির্, না!) কী নিমর্ম, কী পাশবিক এই জীবনধারা। যানজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কমর্কতার্ ইলিশ কেনে ১৪ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পঁুটি কিনতেই নাভিশ্বাস। নব্য গজিয়ে ওঠা কোটিপতি গামের্ন্টস মালিকের ড্রয়িংরুমে শোভা পায় ডোরাকাটা বাঘের চামড়া, লাখ লাখ টাকার শোপিস ইত্যাদি। অথচ গামের্ন্টকমীের্দর তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিকমতো দিতে তারা গলদঘমর্ হয়ে যান। ওইসব খেটে মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিংড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে ফেরার নিশ্চয়তাটুকুও নেই। মধ্যরাত পযর্ন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অথর্নীতির চাকা সচল থাকে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়। যা এই দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন আর এখন এসব জীবনযোদ্ধারা দেশ গড়ছেন। আসলে এই যে এতসব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে/ যে মাটি অঁাচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে’। দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? একাত্তরে যা করেছে বীর বাঙালি। কাজী নজরুল ইসলাম তার কোরবানি কবিতায় বলেছেন, ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্য-গ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ কোরবানি ঈদ কেবল নিছক পশু জবাই আর মাংস খাওয়ার ব্যাপার নয়। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই ঈদ। মনের পশুকে কোরবানি দিয়ে মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে। এ জন্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের আধার হচ্ছে পাঠাগার। গ্রন্থাগার হচ্ছে লেখক, পুস্তক ও পাঠকের সম্মিলনস্থল। সভ্যতার দপর্ণ। একটি দেশ তথা সমাজের সাবির্ক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চচাের্কন্দ্রও এই পাঠাগার। বিত্তবান অনেকেই আছেন যারা তাদের অজির্ত অথের্র একটা অংশ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন। সে ক্ষেত্রে পাঠাগার হতে পারে উত্তম জায়গা। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, তার থেকে অন্ধকার দূর করতে হলে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবতির্কা। এ জন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আজকের একজন তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য পাড়া মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। সমাজে সৌহাদর্্য আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে পাঠাগার। আমরা আমাদের সমাজটাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধাররূপে গড়ে তুলতে পারব ততই সমাজ এগিয়ে যাবে। আর একটি উন্নত সমাজব্যবস্থায় উৎসব হবে আরও আনন্দময় এবং অথর্পূণর্। শেকড়ের টানে ঘরে ফেরাও তখন সাথর্ক হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেদিকে। ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট