কেউ শুধায় না নাগরিকের কী প্রয়োজন

হাজারটা সমস্যা নিয়েও ভালোবাসার শহর, স্বপ্নের শহর ঢাকা আমাদের। আমরা চাই জনসমর্থন নিয়ে আসুক আনিসুল হকের মতো সৃজনশীলতা, স্বপ্নের একজন ফেরিওয়ালা। স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা, যাকে লজ্জিত করবে, ব্যথিত করবে।

প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
নির্বাচন এলে চেনা যায় নাগরিকের সেবা করার জন্য কত মানুষ উদগ্রীব। ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের যুধিষ্ঠীর মতো সত্যবাদী দাতা হাতেম তাইয়ের মতো দানবীর ন্যায়পরায়ণ মুখ দেখা যায় একমাত্র নির্বাচনের সময়। বস্তিতে কাদায়, নোংরা এলাকায় তখন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পদচারণা। কালিমাখা হাত, মলিন পোশাক, দরিদ্র অবহেলিত মুখ সব বিভেদ ঘুচে যায়। দূরের স্বপ্নের মানুষ তখন হাতে হাত মিলিয়ে বুকে বুক মিলিয়ে বৈষম্যহীন, সমতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন সৃষ্টিতে ব্যস্ত। দেশ এগিয়ে যায়, ডিজিটাল হয়। নির্বাচনী প্রচারণা কেন সেই পুরনো আমলে পড়ে আছে? সেই একই মিথ্যে প্রতিশ্রম্নতি, একই অভিনয়, একই মারামারি, একই মিথ্যে। নেচে, গেয়ে, মাইকিং করে কে কতটা যোগ্য কত দরদি তা প্রমাণের চেষ্টা। কথা আর পোস্টারে ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর নতুনত্ব যোগ হয়েছে প্রচারণার সেস্নাগানে। যেমন: যত চিপবেন তত রস, ওমুক আপার 'আনারস'। এই যে শত শত 'জনদরদি' নানাভাবে তাদের প্রতিশ্রম্নতির বন্যায় পস্নাবিত করছেন ঢাকা শহরের নাগরিকদের তারা কি একবারও নাগরিকদের কাছে জানতে চেয়েছেন, 'এ শহরের কোন এলাকায় কী প্রয়োজন?' এরশাদের আমালে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বিভিন্ন ওয়ার্ডের নাগরিকদের সমস্যা, অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিবেদন ছাপাতো ধারাবাহিকভাবে। আমাকে বলা হলো পোস্তগোলা এলাকার নাগরিক সমস্যা নিয়ে কাজ করতে। সাতদিন এলাকার বিভিন্ন পেশার মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সমস্যা, চাহিদা, অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন জমা দিলাম। কাজটা আমায় যখন দেয়া হয়েছিল তখন ভয় পেয়েছিলাম ঠিকমতো কাজটা করতে পারব তো; কিন্তু যখন ফিল্ডে গেলাম তখন নানা ধরনের মানুষের সহযোগিতা আমায় মুগ্ধ করেছিল। হাবীব ভাইয়ের নির্দেশনা আর এলাকার কিছু কিশোর যুবকের সাহায্যে একটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়েছিল। এই যে এত এত ভাই-বোনেরা আমাদের সেবা করার জন্য রাতদিন সংগীতে, নাচে আমাদের ধন্য করছেন তারা কেউ কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে না হোক কিছু মানুষের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছেন কার ওয়ার্ডে কী সমস্যা রয়েছে। এলাকাভেদে সমস্যার ধরন আলাদা নাগরিকের চাহিদাও আলাদা। সুতরাং আগামী দিনের নগরের দায়িত্ব যারা নেবেন তারা কেন জানবে না নাগরিক সমস্যার কথা অথবা কোন সমস্যাটির আগে সমাধান প্রয়োজন? বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাই ভোট চাচ্ছে কিন্তু একবারও প্রশ্ন করছে না এই এলাকায় আপনার কী কী সমস্যা হচ্ছে? আমি থাকি ৫২নং ওয়ার্ডে। কর্মক্ষেত্র ৫৩নং ওয়ার্ডের পাশাপাশি ওয়ার্ড হওয়ায় সমস্যাগুলোও মোটামুটি এক। গত এক দশক ধরে এ এলাকায় অন্য এলাকার কেউ এলে প্রথমেই রাস্তা দেখে যে কথাটি বলতো তা হলো- 'এখানে কি মানুষ থাকে?' আমার নব্বই বছর বয়সি বাবা সারাদিন দুশ্চিন্তা করতেন, অসুস্থ হলে তাকে কী করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ড্রেন আর রাস্তা একাকার হওয়ায় রিকশা নিয়ে কতজন যে রাস্তায় পড়েছে তার হিসাব নেই। বহু প্রতীক্ষিত এ সমস্যার সমাধান মোটামুটি হলেও যে রাস্তাগুলো কোনো উন্নতি হয়নি সেখান দিয়ে ড্রেনের পানিতে পা চুবিয়ে হাঁটতে হয়। দূষণের শহর ঢাকা। তার মধ্যে সেরা জুরাইন, শ্যামপুর এলাকা। রাস্তা উঁচু হওয়ায় বেশির ভাগ বাড়িই নিচু হয়ে গেছে। ফলে এখানে প্রায় বাড়িতেই কোনো না কোনো কারখানা। আবার কেউ কেউ বসতবাড়ির মধ্যে কারখানা ভাড়া দিয়ে নিজে থাকেন উন্নত এলাকায়। কারখানার শব্দ, কেমিক্যালের গন্ধে দরজা-জানালা বন্ধ করেও ঘরে থাকা দায়। ভোট শেষে শিল্পপতি আর সাধারণ জনগণ এক থাকে না। ফলে এ সমস্যাও কেউ দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। পরিবেশ অধিদপ্তর নামে এ দেশে একটি অধিদপ্তর আছে। বিশেষ বিশেষ সময়ে টিভিতে তাদেরর্ যালি দেখি। আর কী কাজ তাদের তা জনগণ জানে না। ওয়াসার পানি নিয়ে 'মিজানুর রহমান'-এর ওয়াসার এমডির শরবত পানের খবর সারা দেশবাসী দেখছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই। গ্যাস সমস্যা বহুদিনের। মাসে মাসে বিল পুরোটাই পরিশোধ করতে হয় অথচ মাঝরাতে উঠে রান্না করতে হয়। এ সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বললে পরিবেশ অধিদপ্তর, তিতাস, ওয়াসার দোহাই দেয়া হয়। প্রশ্ন হলো- মেয়র, কাউন্সিলের তা হলে ভূমিকা কী? ঢাকা উত্তরের মেয়র চা বানিয়ে বিতরণ করে আলাদা নিদর্শন তৈরি করে আলোচনায়। তিনি কি কুর্মিটোলার ধর্ষণের জন্য লজ্জিত হয়েছেন? একটি মেয়েকে নিরাপত্তা দিতে না পারার জন্য, সিসি ক্যামেরা না থাকার জন্য তিনি কি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন? ঢাকার রাস্তাঘাট নারীদের জন্য নিরাপদ করার জন্য, সড়কের মৃতু্য ফাঁদ থেকে নাগরিকদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি কেউ কি দিয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, ভালো ভালো স্কুল সব ধানমন্ডি, গুলশান, বসুন্ধরা, উত্তরার দিকে। জুরাইন, পোস্তগোলা এলাকার শিক্ষার্থীরা যানবাহনে কতটা কষ্ট করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায় তা বিত্তবানদের জানা হবে না কখনো। সন্ধ্যারদিকে যে বাসগুলো ধানমন্ডি এলাকা থেকে আসে তারা মহিলা সিটে পুরুষ বসিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে। নারীদের বা নারী শিক্ষার্থীদের বাসে তুলতে তাদের অনীহা। কোনো মেয়ারপ্রার্থী কি এ পর্যন্ত বলেছেন, নারীদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করবেন। শিক্ষার্থীদের জন্য সকাল এবং সন্ধ্যায় আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা হবে? ঢাকা উত্তর থেকে দক্ষিণ। উন্নত থেকে অনুন্নত এলাকা সর্বত্র যে সমস্যায় সমতা আছে তা হলো, ধর্ষণ আর নেশা। চিড়া, মুড়ির মতো ইয়াবা, ফেনসিডিলের কেনাবেচা প্রতিটি এলাকায়। জনগণ দেখে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া নেশা বিক্রির মানুষকে শুধু পুলিশ এদের খুঁজে পায় না। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েদের ওড়না ধরে, হাত ধরে টান দেয়ার ছেলেদের দেখেও কেউ দেখে না। এলাকাভিত্তিক মুরব্বিদের শাসন এখন আর সমাজে নেই। নিজের সম্মান রক্ষার্থে মুরব্বিরা বেয়াদবি দেখেও না দেখার ভান করে চলে যান। একজন মানুষের হাতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ থাকে না। নানা সীমাবদ্ধতা, সমন্বয়ের অভাবে চাইলেও অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। কিন্তু জনগণের কোন চাহিদা কত নম্বর রেখে সমাধান করতে হবে তা নির্ণয় জরুরি। নির্বাচন আসে। জনগণ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রার্থীরা আমাদের স্বপ্ন দেখান। আমরা অপেক্ষায় থাকি দীর্ঘ বঞ্চনা থেকে মুক্তির। তারপর আবার একই সমস্যা। নির্বাচন শেষে সব হাস্যোজ্জ্বল অবয়বের পরিবর্তন হয়, প্রতিনিধিদের কাছাকাছি যাওয়ার অধিকার সংকুচিত হয়, সমস্যা শোনার সময় থাকে না। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিশ্রম্নতি পূরণ না করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা উচিত। জনগণের সমস্যাগুলো শোনার জন্য অভিযোগ বাক্স রাখা হোক। সর্বোপরি জনগণের দুর্ভোগের জন্য জনপ্রতিনিধিদের লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার সংস্কৃতি শুরু হোক। হাজারটা সমস্যা নিয়েও ভালোবাসার শহর, স্বপ্নের শহর ঢাকা আমাদের। আমরা চাই জনসমর্থন নিয়ে আসুক আনিসুল হকের মতো সৃজনশীলতা, স্বপ্নের একজন ফেরিওয়ালা। স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা, যাকে লজ্জিত করবে, ব্যথিত করবে। শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি কথাসাহিত্যিক শিক্ষক ও কলাম লেখক