জ্ঞানের দেবী সরস্বতী

ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বিদ্যার ও ললিতকলার দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছেন সেই আদিকাল থেকে। কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরেও দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। যবদ্বীপে পাওয়া পদ্মাসনে বসা সাত তারের বীণা হাতে সরস্বতী দেবীর মূর্তি, তিব্বতে বজ্রধারিণী ময়ূর নিয়ে বজ্র সরস্বতী দেবী ও বীণাপাণি দেবী সরস্বতী, জাপানে বেনতেন নামধারিণী সর্পাসনা দ্বিভুজা বীণাপাণি, অষ্টভুজা হপ্পিবেনতেন সরস্বতী দেবী। চীনদেশে শস্যদেবী কুয়ানযিন এর সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করা যেতে পারে।

প্রকাশ | ৩০ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্‌পতিও। ইন্দ্রও বাক্‌পতি। বৃহস্পতি-পত্নি সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভান্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে সরস্বতী তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবলমাত্র বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞানের দেবীতে পরিণত হলেন। শ্রীপঞ্চমীর দিন খুব সকালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের ঘরে ও সর্বজনীন পূজামন্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বজনীন পূজামন্ডপগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে। সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে কিন্তু সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন (অস্ত্যর্থে)+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব, সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। পুরাণে বলা হয়েছে- দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। তিনি বাক্য, বৃদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা প্রভৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ওই গ্রন্থের মতে সরস্বতী পূজার প্রবর্তক ব্রহ্মা এবং শ্রীকৃষ্ণ। পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগদেবীরূপে প্রসিদ্ধা। ঋগ্বেদে সরস্বতীর সঙ্গে বিদ্যাধিষ্ঠাতৃত্বের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগ্‌দেবী। সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রম্নঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী- লক্ষ্ণী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদীরূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে সরস্বতী নদী ও সরস্বতী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার তত্ত্ব। পন্ডিতরা অনেকেই মনে করেন যে, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, 'আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। বর্তমানে গঙ্গা যেমন হিন্দুরা উপাস্যদেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী।' ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উলেস্নখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভুজা অথবা চতুর্র্ভুজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী পূজিতা হন। ইনি অক্ষমালা, কমন্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভুজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা। বর্তমানে সরস্বতী প্রায় সব জায়গায়ই দ্বিভুজা। তার হাতে বীণা অপরিহার্য। বীণা অবশ্যই সঙ্গীত ও অন্যান্য কলাবিদ্যার প্রতীক। অক্ষরমালা বা জপমালাও আধ্যাত্মবিদ্যার প্রতীক। শুকপাখিও বিদ্যা বা বাক্যের প্রতীক হিসেবেই সরস্বতীর হাতে শোভা বাড়াচ্ছে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, 'দ্বিভুজা বীণাপাণি সরস্বতী প্রতিমা গত ১৫০ বছরের মধ্যে কল্পিতা হয়েছে।' ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বিদ্যার ও ললিতকলার দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছেন সেই আদিকাল থেকে। কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরেও দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। যবদ্বীপে পাওয়া পদ্মাসনে বসা সাত তারের বীণা হাতে সরস্বতী দেবীর মূর্তি, তিব্বতে বজ্রধারিণী ময়ূর নিয়ে বজ্র সরস্বতী দেবী ও বীণাপাণি দেবী সরস্বতী, জাপানে বেনতেন নামধারিণী সর্পাসনা দ্বিভুজা বীণাপাণি, অষ্টভুজা হপ্পিবেনতেন সরস্বতী দেবী। চীনদেশে শস্যদেবী কুয়ানযিন এর সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করা যেতে পারে। \হকেউ কেউ আবার মধ্যপ্রাচ্যের মাতৃকাদেবী ইস্‌তার বা ইনান্নার সঙ্গে দেবী সরস্বতীর তুলনা করেছেন। গ্রিকদেবী এথেনির সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য অনেকে কল্পনা করে থাকেন। তবে রোমীয়দেবী মিনার্ভার সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। আইরিশ দেবী ব্রিঘিদ কাব্য, শিল্প ও আরোগ্যের দেবী হিসেবে মিনার্ভার প্রতিরূপ। রোমারদেবী মিনার্ভা ও কেলটিক দেবী বিঘ্রিদের সঙ্গে প্রকৃতিগত দিক থেকে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য আছে ঠিকই, তবে এই দুই দেবীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভাব নয়। কেবলমাত্র জাপানি বিদ্যাদেবী বেনতেন যে ভারতবর্ষীয় সরস্বতী দেবীর বিদেশে আতিথ্য গ্রহণের সাক্ষ্য, এটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রত্যেক দেবদেবীই এক একটি বিশেষ শক্তির অধিকারী এবং তাদের মূর্তিভাবনার মধ্যে বিশেষ বিশেষ তত্ত্বের সংকেত আছে। কেবল রাজসিক ও তামসিক আড়ম্বরে প্রমত্ত না হয়ে যদি সাত্ত্বিক বিবেক নিয়ে আমরা দেবারাধনায় প্রবৃত্ত হই, তবে মাটির প্রতিমার কথা আমাদের মনেই হয় না। আমরা দেখি এক তত্ত্বময় বিগ্রহ আমাদের সামনে বিরাজ করছে। সে বিগ্রহ প্রাণময়, যেন কথা বলতে চান, আমরা যতখানি আত্মস্থ হই, ততখানি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেন। আমাদের অন্তঃপ্রজ্ঞায় তিনি তার স্বরূপমহিমা নিয়ে জাগ্রত হন। দেবতার আননকমলের স্মিত হাসি পর্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সে হাসির অপার্থিব স্নিগ্ধ মধুরিমা আমাদের অন্তরে পরম শান্তির অমৃতপ্রলেপ অঙ্কিত করে দেয়। আমাদের শূন্য হৃদয় পূর্ণ করে দেয়। তখন বুঝতে বাকি থাকে না- পূজা সার্থক হয়েছে। শক্তির পূজায় শক্তিলাভ ঘটেছে। তত্ত্বের পূজায় তত্ত্বোপলব্ধি হয়েছে। তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ