বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু

বাঙালি জাতির ভাগ্যোন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞের বর্ণনা ও মূল্যায়ন করা সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একই নয়নের দুটি পাতা।
বিমল সরকার
  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

এককথায় বলতে গেলে অসাধারণ। তেজ, শক্তি, সাহস এবং ধৈর্য-স্থৈর্যে অনন্য। নিখাদ দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসার বন্যায় তার হৃদয় ছিল থইথই। দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। আর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব? রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায়। ১৯৭০ সালে আমাদের দেশে মোট উনিশটি জেলা। মহকুমাও ছিল বোধকরি চলিস্নশটির মতো। এ ছাড়া ছিল সাড়ে চারশ'র বেশি থানা। এগুলোর মধ্যে সবকটি জেলা ও মহকুমা এবং সাড়ে তিনশ'র বেশি থানায় গিয়ে তিনি নির্বাচনী জনসভা করেছেন। জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় জেলা থেকে জেলা, থানা থেকে থানা, শহর-বন্দর-গঞ্জ-গ্রাম, বলতে গেলে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ জনপদ বাদ নেই যেখানে তিনি যাননি; জনসভায় বক্তৃতা করেননি। সবখানে তিনি শোষিত ও বঞ্চিত-অবহেলিত বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা এবং জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। দুই দশক ধরে রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে অবশেষে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় হ্যামিলনের সেই বিখ্যাত বংশীবাদকের মতোই অসাধারণ বাগ্মিতা আর সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের পরশে তিনি একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সমবেত জনস্রোত ও দেশবাসীর উদ্দেশে তার বজ্রনিনাদ কণ্ঠস্বর 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' মুক্তিপাগল জাতির ঐক্য ও সংহতিকে দৃঢ়তর করে। ক্রমে তিনি গোটা জাতির আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেন। মূলত ওই ঘুমজাগানিয়া ভাষণের পর সবারই উপলব্ধিতে আসে যে বাঙালি জাতিকে আর কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখা যাবে না। এর আগে এমন জনপ্রিয় নেতা এ দেশে আর বোধ করি জন্মাননি।

জন্ম যাদের এই বাংলার পুত-পবিত্র মাটিতে, তাদের সবার সহজেই হৃদয়ঙ্গম হওয়ার কথা যে এতক্ষণ কার কথা বলা হলো। এই মহান নেতা আর কেউ নন, গোপালগঞ্জ জেলার এক নিভৃতপলস্নী টুঙ্গিপাড়ার শেখকুল চূড়ামণি। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুন এবং নিকটাত্মীয়দের আদরের খোকা। আর অন্যদের কাছে শেখ মুজিব। সাধারণ মানুষের কাছে যিনি শেখ সাহেব বলে সমধিক পরিচিত। শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার স্থপতি। বাংলাদেশের জাতির পিতা। বাঙালি জাতির নয়নের মণি। জনগণমন অধিনায়ক। জনমানুষের হৃদয়রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি। জাতির অবিসংবাদিত নেতা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

\হদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকসেনারা গ্রেপ্তার করে। পরবর্তী সময়ে বন্দি অবস্থায় তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে রেডিও ও টেলিভিশনে প্রদত্ত এক ভাষণে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং এর সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন। শুরু হলো দেশব্যাপী মুক্তির লড়াই। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু না। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেও জাতির উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা এবং অপরিপূর্ণতা থেকেই যায়। দেশজুড়ে এত আনন্দ আর উলস্নাসের মাঝে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুই কি না অনুপস্থিত! ইতোমধ্যে বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের অব্যাহত চাপ, বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সব অপতৎপরতার নাটেরগুরু ভুট্টোর শেষ পর্যন্ত টনক নড়ে। শিগগিরই বোধোদয় ঘটে তার। তিনি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

৮ জানুয়ারি শনিবার পাকিস্তান সরকারের একটি বিশেষ বিমান বঙ্গবন্ধুকে বহন করে লন্ডনের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করে। ১০ জানুয়ারি স্বদেশের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ছাড়েন। ভারত হয়ে অতঃপর ঢাকা। রেসকোর্স ময়দানে তৈরি সংবর্ধনামঞ্চে উঠার সময় লাখ লাখ মানুষের করতালি, উলস্নাস, আবেগ আর 'জয় বাংলা' ও 'জয় বঙ্গবন্ধু' এবং 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা' ধ্বনি যেন একাকার হয়ে যায়।

নিজের জীবনকে বাজি রেখে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। দেশে এবং দেশের বাইরে বাঙালি জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করে গেছেন। সংকল্পে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও অবিচল। এমনকি মৃতু্যভয়ও এই সিংহপুরুষকে তার আদর্শ ও সংকল্প থেকে কখনও বিচু্যত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর জন্য পাকিস্তানের মাটিতে কবর পর্যন্ত খোঁড়া হলেও জলস্নাদ বাহিনীর হাত থেকে সৌভাগ্যক্রমে তিনি প্রিয় স্বদেশবাসীর মাঝে ফিরে আসেন। তার সাহসী ও সদম্ভ উচ্চারণ 'আমি বাঙালি, আমি মুসলমান- একবার মরে, দুইবার মরে না' আজও গোটা জাতির জন্য সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকার সাহস এবং অনুপ্রেরণা জোগায়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসে ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালিয়ে পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা দেশটিকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ফেলে। স্বজন, সম্পদ এবং বাড়িঘর হারিয়ে চারদিকে মানুষের মাঝে কেবলই হাহাকার। কেবল নেই আর নেই। এমনই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু মনোযোগী হন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন কাজে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে আজীবন লালিত 'সোনার বাংলা ও সোনার মানুষ' গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যখন তিনি ব্যস্ত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার মানুষকে দেশের কল্যাণে একত্রিত করে সামনের দিকে দ্রম্নত এগিয়ে চলেছেন, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কুক্ষণে দুষ্টগ্রহের মতো আবির্ভূত হয়ে একদল দেশীয় কুলাঙ্গার নিমেষে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে কেবল বঙ্গবন্ধু নয়, সমগ্র জাতিরই স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধূলোয় মলিন করে দেয়।

মতলববাজ কুলাঙ্গাররা কখনো কোনো স্থান-কাল-পাত্রের গন্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। যুগে যুগে, দেশে দেশে মহৎ ও সরলপ্রাণ ব্যক্তিদের উদারচিত্ততার সুযোগটিই ওরা গ্রহণ করে থাকে। ওদের ভাবগুরুরাই ১৯৪৮ সালে ভারতের মহাত্মা গান্ধীকে প্রার্থনা সভায় প্রবেশকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারবার নিরাপত্তা দিতে চাইলেও মহৎপ্রাণ গান্ধীজী তা গ্রহণ করেননি। আমেরিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মার্টিন লুথার কিংকে ১৯৬৮ সালের ৩ এপ্রিল দুর্বৃত্তরা হত্যার হুমকি দেয়। কিংয়ের সহকর্মীরা তাকে অন্যত্র চলে যেতে পরামর্শ দেন। কিন্তু নির্ভীক লুথার কিং কিছুতেই সেখান থেকে গেলেন না। বরং সবাইকে হিংসা ত্যাগ করার অনুরোধ জানালেন। পরদিনই আততায়ীর বন্দুকের গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। পরদিনই সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত হয়, রমনা গ্রিনের যে 'প্রেসিডেন্ট হাউসে' বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খান মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে আলোচনা চালিয়েছিলেন সেই ভবনটিকেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে রূপান্তরিত করা হবে। কিন্তু কালবিলম্ব না করে উদারচিত্ত ও সরলপ্রাণ বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি সরকারি ভবনে বাস করবেন না, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতেই থাকবেন। এ দেশে কেউ তাকে খুন করতে পারে এমন দুর্ভাবনা বঙ্গবন্ধুর মাথায়ই ছিল না। বাঙালি জাতির চরম দুর্ভাগ্য, এই ভবনটিতেই ঘাতকরা বিশাল হৃদয় বঙ্গবন্ধুকেসহ স্ত্রী, পুত্র, পরিজনকে সপরিবারে হত্যা করে জাতির ললাটে দুরপনেয় কলঙ্কতিলকটি পরিয়ে দেয়।

ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। কিন্তু বাঙালি জাতির হৃদয়ের আসন থেকে? সেখান থেকে কি তাকে আলাদা করতে পেরেছে; নাকি কোনোদিন আলাদা করা সম্ভব? বঙ্গবন্ধু যে সেখানে অমর, অক্ষয়, অবিনশ্বর। শত অপচেষ্টা করেও বিগত ৪৫ বছরে বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে কি তাকে আলাদা করা গেছে? ছড়ায় বঙ্গবন্ধু, কবিতায় বঙ্গবন্ধু, গানে বঙ্গবন্ধু। শিল্প, কাব্য, সাহিত্য, পালাগান কোথায় নেই তিনি। এই মহান দেশব্রতীর শততম জন্মদিন সমাগত। সবার প্রতি আহ্বান- আসুন, আমরা নিজেদের মধ্যকার সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। নিজের জীবনকে বাজি রেখে সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে যিনি আমাদের মুক্তি এনে দিয়ে নতুন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে গেছেন আসুন তার কাছে ঋণ স্বীকার করি। আর আজকের এই দেশপ্রেমের দুর্ভিক্ষের দিনে মহৎপ্রাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনশ্বর আত্মার কাছে কয়েক কণা দেশপ্রেম ভিক্ষা করি।

বাঙালি জাতির ভাগ্যোন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞের বর্ণনা ও মূল্যায়ন করা সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একই নয়নের দুটি পাতা।

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নাকি বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু তা সঠিকভাবে নির্ণয় করাটাও বোধকরি যে কোনো গবেষকের পক্ষে খুবই দুঃসাধ্য। ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডের পর থেকে ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্বেষী, মতলববাজ এবং অর্বাচীনরা তার নামে কত নিন্দা আর অপবাদই না রটিয়ে আসছে। কিন্তু শত রকমের অপচেষ্টা করেও তারা কেবল ব্যর্থ হয়নি, বরং ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। জাতির ললাট থেকে এই দুরপনেয় কলঙ্কতিলক সেদিনই ঘুচবে, যেদিন জাতির জনক ও তাঁর অতি আপনজনদের আত্মস্বীকৃত সব খুনির বিচারের রায় তারই স্বপ্নের সোনার বাংলায় কার্যকর হবে। পরিশেষে এ প্রসঙ্গে আরেক কীর্তিমান বাঙালি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলতে চাই 'এনেছিলে সাথে করে মৃতু্যহীন প্রাণ, মরণে তাই তুমি করে গেলে দান।'

বিমল সরকার: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<87095 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1