শেষ হলো বহুল আলোচিত রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১ ফেব্রম্নয়ারি। এবারের নির্বাচনী আমেজ বা ডামাডোল ছিল জাতীয় নির্বাচনের মতোই। গগনবিদারী শব্দ আর নকল করা গানের সুর এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যে, জনশ্রবণের বারোটা বেজিয়েছিল, হারাম হয়েছিল নগরবাসীর ঘুম। প্রচার প্রচারণা দেখে মনে হয়েছিল এবার উৎসবমুখর পরিবেশে নগরীতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সাধারণ ভোটারদের কথা বাদই দিলাম, দলীয় ভোটাররাও ভোট দিতে যায়নি। ফলে ভোট পড়েছে দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। উত্তরে ভোটের হার আরও কম ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ভোটের এই চিত্র খুবই হতাশাজনক। ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিকুল ইসলাম নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৪ লাখ ৭২ হাজার ১১ ভোট। আর দক্ষিণে নৌকার প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫ ভোট। অন্যদিকে উত্তরে বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৪১ হাজার ৬১ ভোট। আর দক্ষিণের ধানের শীষের প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ১২ ভোট। বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি।
ভোট কম পড়ার পেছনে তিন কারণকে চিহ্নিত করেছেন তথ্যমন্ত্রী। প্রথমত, টানা তিনদিনের ছুটি ছিল, সে কারণে ঢাকার অনেক ভোটার গ্রামে চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি শুরু থেকেই ইভিএম নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে। এতে মানুষের মধ্যে ইভিএম নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে। ফলে ৭৫ শতাংশ ভোটার কম উপস্থিত হয়েছে। কারণ তারা এটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তৃতীয়ত, তারা (বিএনপি) প্রথম থেকে বলে আসছে, এই নির্বাচনকে আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে নির্বাচনের দু'দিন আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, আমরা একটি সফলতা পেয়েছি। নির্বাচনের কারণে আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি। ফলে জনগণের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে, তারা জয় লাভের জন্য নির্বাচন করছে না। নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না সেটা বিএনপি খোলাসা করেছে। তারা জয় লাভের লক্ষ্যে নয়, আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়েছে। সে কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এসব কারণেই ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।
সচেতন জনসাধারণ মনে করে, দেশে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন ঘটেছে। ফলে একজন পাতি নেতাও পেশি শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং অবৈধ উপায় ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছে। এসব সবাই জানে। সম্প্রতি দুদকের অভিযানেও তা প্রমাণিত হয়েছে। দেশে শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য বাড়বেই। সমাজের অসাম্য, অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচার চলছেই। মানুষ মানুষে যে ভেদাভেদ, সমাজের মধ্যে যে পার্থক্য ও শোষণ তা তীব্র হচ্ছে। প্রতিবাদী চেতনার আগুন জ্বালাবার কেউ নেই। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে। ১০ বছর আগে যিনি ফুটপাতে হাঁটতেন ঠিক মতো সংসার চালাতে পারতেন না। এখন তিনি কোটিপতি। কথায় বলে দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে খুব সহজেই ধনী হওয়া যায়। ক্ষমতা ও রাজনীতির প্রভাববলয়ে থেকে মানুষ দ্রম্নত ধনী হচ্ছে। অথচ বলা হয়ে থাকে কোনো ব্যক্তি যদি টানা ১৬ ঘণ্টা ৩২ বছর পরিশ্রম করেন তবে তারপক্ষে কোটিপতি হওয়া সম্ভব। অবাক ব্যাপার যে, এখন আর কেউ পরিশ্রম করেন ধনী হতে চান না। দেশের ৯০ ভাগ মানুষের স্বপ্ন কোটিপতি হওয়া। এর প্রধান কারণ দেশে অসুস্থ ও অসম পুঁজির বিকাশ।
জনস্বার্থ ও জননিরাপত্তা সংরক্ষিত না হওয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দুটোই বেড়েছে। তারা এটাও ভাবছে, যাকে ভোট দেব- তিনি কি সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক বা মানবিক? তিনি কি জনগণের পক্ষের, জনবান্ধব? যদি কোনোটাই না হয়ে থাকে তা হলে সময় নষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাবে কেন ভোটাররা। মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীদের ব্যাপারে যে নেতিবাচক মানসিকতা, মূলত এই কারণে তারা ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এটা দেশের গণতন্ত্রের জন্য শুভ বার্তা নয়। যে করেই হোক, ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় ঢাকাবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, 'আমি ঢাকাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, ভোটাররা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রকে জয়যুক্ত করেছেন।' প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়রকে নির্দেশনাও দিয়েছেন। আমরা আশাবাদী। সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়তে চান দুই মেয়র। নগর উন্নয়নের তারা যে ইশতেহার দিয়েছেন তা স্বাপ্নিক হলেও এগোলো অবাস্তবায়ন যোগ্য নয়। আমরা মনে করি, নিজেদের পরিকল্পনার সঙ্গে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের পরিকল্পনাও তাদের অনুসরণ করা উচিত।
এটা সত্য, রাজধানী ঢাকার সমস্যার অন্ত নেই। এখানে রয়েছে তীব্র যানজট, আবাসন সমস্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ জনসংখ্যার আধিক্য, জলাবদ্ধতা ও সুয়ারেজ সমস্যা। নগরের রাস্তায় নাকে রুমাল দিয়ে চলাচল করতে হয়। এ ছাড়াও রয়েছে ছিনতাই, গুম, অপহরণ। নগরে হত্যাও বাড়ছে। রাজনৈতিক চোর-ডাকাত বাড়ছে। বাড়ছে টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ও দখলবাণিজ্য। ভূমিকম্পপ্রবণ রাজধানী ঢাকা। ঢাকার বস্তিতে উঁচু ভবনে প্রায়ই আগুন লাগে, ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। এতসব সমস্যার সমাধান করে স্বাপ্নিক ঢাকা বা বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা করা কিংবা তা বাস্তবায়ন করা কঠিন।
মনে রাখতে হবে- গত বছর রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ ছিল। ডেঙ্গু জ্বরে ১৭৩ জনের মৃতু্য হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি। এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে এক লাখের ওপরে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা নিধনে বছরব্যাপী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দুই সিটি করপোরেশন ও সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না। কারণ জনগণের জান-মাল রক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। ঢাকার দুই মেয়রের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এ ব্যাপারে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। সুন্দর বাসযোগ্য নিরাপদ ঢাকা নগরবাসীকে উপহার দেবেন। সরকার, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল- যাই বলুক না কেন, ভোটারদের প্রতি আস্থা ফেরাতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, জনআস্থা আরও নিচে নেমে যাবে এবং কেবল রাষ্ট্রের অর্থই অপচয় হবে- যা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।