ঈদুল আজহার তাৎপযর্ ও আমাদের করণীয়

হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এ অসাধারণ কোরবানির প্রেরণা নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নবী করিম (সা.) তার উম্মতকে পশু কোরবানির আদেশ দিয়েছেন। তাই বিশ্বের প্রতিটি সামথর্্যবান মুসলমান প্রত্যেক বছর ১০ যিলহজ তারিখে কোরবানি করে থাকে।

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

মাহমুদ আহমদ
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃপায় আগামীকাল আমরা ঈদুল আজহা উদ্যাপন করব, ইনশাল্লাহ। মুমিন বান্দার জীবনে কোরবানির গুরুত্ব সীমাহীন। কারণ মুমিনের জীবনের একমাত্র আরাধনা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। আর প্রকৃত কোরবানি তাকে অত্যন্ত দ্রæত আল্লাহর নৈকট্যে ভূষিত করে। আমরা বাঙালি কোরবানির ঈদ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কোরবানি শব্দের অথর্ নৈকট্য, ত্যাগ, উৎসগর্। অথার্ৎ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। কোরবানির ঈদ পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধমর্প্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিদের্শ দিচ্ছেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকতার্র উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন’ (সুরা কাউসার, আয়াত-২)। কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয় তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসগর্ করতে সদা প্রস্তুত থাকে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহি:প্রকাশগুলো আল্লাহতায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তার পুত্রকে জবাহ করছেন (সুরা সাফ)। যেভাবে কোরবানি কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন: এই দিনই মিনা ময়দানে, পুত্র-স্নেহের গদাের্ন, ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে, রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম সে আপনা রুদ্র পণ! ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন! আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদ-সম মোল্লা খুন-বদন! ওরে হত্যা নয় আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ পিতা ইব্রাহিম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, আরে ইব্রাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি তোমাকে নিজ পুত্রকে আমার পথে উৎসগর্ করতে বলেছি, হত্যা করতে নয়। তোমার পুত্র সারাজীবন লোকদের বুঝাবে আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন দুম্বা বা ছাগল জবাই করলেন? এর উত্তর হলো: যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটতো তাহলে তৎকালীন ধমীর্য় রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো জাতিতে প্রভুকে বা দেব-দেবীদেরকে খুশি করার জন্য নরবলি তথা মানুষ কোরবানি চলমান থাকত। অতএব আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবাহ করার জিনিস নয়, জবাহ যদি করতে হয় তাহলে পশু জবাহ কর। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, হযরত রসুলে পাক (সা.) এর শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা একশত উট জবাহ করেছিলেন (সিরাতে নববী)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু জবাই করা রসুল (সা.) প্রচলন করেননি বরং পূবের্ই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা হতো। পশু কোরবানির আরও একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে মুসা (আ.) এর জাতিকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তোমরা যে গাভীকে পূজা করো, সে পূজনীয় নয় বরং আমি পূজনীয়, অতএব সেটাকে জবাহ করো’ (সুরা আল বাকারা, রুকু ৮) গরু তোমাদের উপকারাথের্ সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা এর দুধ পান করতে পারো এবং গোশত খেতে পারো আর এর মাধ্যমে অন্যান্য উপকার সাধন করতে পারো। মূল উদ্দেশ্য হলো, হৃদয়েও যদি কোন পশু থাকে সেই পশুকে হত্যা করতে হবে, সেটাকে জবাই করতে হবে। হাদিসে আছে, পশু জবাই খোদা তায়ালার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম তবে তা ঐ ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সাথে কেবল খোদা তায়ালার ভালোবাসায়, খোদার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ইমান সহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অথর্ অনুগত্য। আসলে আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কোরবানি করছে, তা তিনি ভালো করেই জানেন। আসলে মানুষের মধ্যে সব লোভ লালসা দুর করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সকল পশুত্বকে বিসজের্নর শিক্ষাই হলো কোরবানির শিক্ষা। তাই কোরবানির অন্যতম ধমীর্য় উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা। কাজী নজরুল ইসলাম তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন- ‘মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বঁাচে বঁাচে সবাই।’ এই পশু কোরবানি সম্পূণর্ রূপক। আল্লাহর পথে ত্যাগই ঈদের আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মানে দান নয়, তা ত্যাগ। তাই তো কবি নজরুল ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘চাহি নাকো দুম্বা-উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট। চাই কোরবানি, চাই না দান।’ আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর নামে কোরবানি করে তাদের জন্য সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় কোরবানির বিষয়ে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। কারও হৃদয়ে যদি এমন ধারণার উদ্রেক হয় যে, প্রতি বছরই তো কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি এবার না হয় দিলাম না, এমনটি চিন্তাভাবনা মোটেও ঠিক নয়, কেননা কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয় বরং তা সারা জীবনের জন্য। হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানি করা আবশ্যক’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামথর্্য লাভ করে অথচ কোরবানির আয়োজন করেনি, সে যেন আমাদের ঈদ গাহের কাছে না আসে’ (ইবনে মাজাহ)। হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল করিম (সা.) মদীনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং বরাবর কোরবানি করেছেন (তিরমিযী)। মহানবী (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে একটি করে সওয়াব দান করা হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় (মেশকাত)। কোরবানির বিনিময়ে সওয়াব পেতে হলে অবশ্যই কোরবানিটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। যেভাবে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির জন্তুর রক্ত-মাংস কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে পেঁৗছায় না। তার কাছে পেঁৗছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া’ (সুরা আল-হাজ: ৩৭)। অতএব তাকওয়া তথা খোদাভীতি লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। আর প্রকৃত কোরবানি হলো নিজ আত্মার কলুষতাকে জবাহ করা, আত্মার আমিত্বকে জবাহ করা, আত্মার অহঙ্কারকে জবাহ করা। এখন আমাদেরকে ভাবতে হবে, আমাদের এ কোরবানি কি তাকওয়ার কোরবানি নাকি লোক দেখানো কোরবানি? ঈদুল আজহা আসার আগ মুহুতে ফ্রিজ কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপন, ডিপ ফ্রিজে বিরাট ছাড়-এগুলো কি আমাদের তাকওয়ার দিকে আকষর্ণ করছে নাকি গোশত জমানোর দিকে? আল্লাহ রসুল কোরবানির গোশত কোন ফ্রিজে রাখতেন? নিজেরা সামান্য খেয়ে বাকীটা সবার মাঝে বণ্টন করে দিতেন। কেউ হয়তো বলতে পারেন তখন তো ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু গোশত অতিরিক্ত হলে শুকনো করে রাখতে পারত কিন্তু তিনি (সা.) কখনো তা করেন নি। আমাদেরকে এত বড় ছাড় দেয়া হয়েছে যে, তিন ভাগের একভাগ নিজেরা খাবো, এক ভাগ আত্মীয়দেরকে দিব আর এক ভাগ গরীব মিসকিনদেরকে। বাস্তবে দেখা যায়, পারলে সবটা নিয়ে ফ্রিজে ঢুকানো হয়। আর তা-ও যদি না হয় তবে তিন ভাগের এক ভাগ বিলিয়ে দিয়ে বাকি দু’ভাগ ফ্রিজে। আত্মীয়ের ভাগের কথা বললে বলে, আত্মীয় তো বাসায় এসে রান্না করা গোশত খাবে! কত বড় স্বাথর্পর আমরা। সবাই যদি আত্মীয়ের ভাগ আত্মীয়কে দেই তাহল প্রত্যেকের সাথে একটা হৃদ্যতার সম্পকর্ সৃষ্টি হবে আর আল্লাহপাকও খুশি হবেন। তাহলে এ বিষয়ে আমাদের কেন এত কাপন্য। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এ অসাধারণ কোরবানির প্রেরণা নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নবী করিম (সা.) তার উম্মতকে পশু কোরবানির আদেশ দিয়েছেন। তাই বিশ্বের প্রতিটি সামথর্্যবান মুসলমান প্রত্যেক বছর ১০ যিলহজ তারিখে কোরবানি করে থাকে। হজরত ইসমাঈল (আ.) যেভাবে পিতার ছুরির নিচে মাথা পেতে দিয়েছিলেন আর কোরবানির পশু যেভাবে ছুরির নিচে মাথা পেতে দেয় তেমনই প্রত্যেক মুসলমানের এ প্রতিজ্ঞা হওয়া আবশ্যক যেন ধমের্র খাতিরে ইসলামের পথে তারা নিজেদেরকে এভাবে কোরবানি দিতে প্রস্তুত থাকে। আবার কোরবানির পশুর মত নিজেদের পশুত্বকে বলি দেয়ার শিক্ষাও আমরা কোরবানি থেকেই পেয়ে থাকি। কেবল গোশ্ত খাওয়াই এ কোরবানির উদ্দেশ্য নয়। মহান আল্লাহর দরবারে প্রাথর্না এটাই, হে আল্লাহ! আমাদের এ কোরবানি তুমি গ্রহণ কর আর আমাদের আত্মাকে পবিত্র কর। মাহমুদ আহমদ: ইসলামী গবেষক ও কলাম লেখক সধংঁসড়হ৮৩@ুধযড়ড়.পড়স