ভাষার মাস বইয়ের মাস

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আজহার মাহমুদ
বাংলা ভাষা। আমার মায়ের ভাষা। আমার প্রাণের ভাষা। তাজা রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের মুখের ভাষা। যে ভাষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বারসহ নাম না-জানা কত ভাই প্রাণ দিয়েছিল। তাই এ ভাষা আমার কাছে প্রাণের ভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে যারা আমাদের বাংলা ভাষাকে করেছে মর্যাদাপূর্ণ তাদের জানাই সালাম। রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই ভাষা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরপরও আমরা কেন জানি এই ভাষার সম্মান আর মর্যাদা রাখতে পারছি না। ১৯৫২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে এ ভাষাকে যারা মহান করেছে আজ আমরা যেন তাদের সেই কর্মের সম্মান রাখতে পারছি না। আমরা এখন বাংলা ভাষাকে অপমান আর অপদস্ত করছি প্রতিনিয়ত। আমার দেশে কিছু কিছু অতিশিক্ষিত রয়েছে যারা বাংলার মাঝখানে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে পারে। কথায় কথায় কয়েকটা ইংরেজি বলে বাংলাকে যেমন ছোট করা হয়, তেমনি যারা বলে তারা নিজেকে বড় মনে করে। আমরা ফেসবুকে এখন বাংলায় লিখি না। লিখি ইংরেজিতে বাংলা। ঘুরে-ফিরে আমাদের অক্ষর থাকে ইংরেজি। আমরা আ, ই, ক, খ এখন ভুলে গিয়েছি। ধ ন প ফ আমাদের কাছে এখন পরিচিত শব্দ। এখনো অনেক লোক রয়েছে যারা বাংলা ভাষায় কয়টি অক্ষর রয়েছে সেটিও জানে না। জানলেও বলতে পারে না। বাংলা বানান সম্পর্কে আমাদের ধারণা না থাকলেও ইংরেজি গ্রামার সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রচুর। এটাই হচ্ছে আমাদের বাঙালিত্ব। আজ মনে পড়ে যাচ্ছে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সেই কবিতাটি। যেখানে তিনি বলেছেন, ছেলে আমার খুব 'সিরিয়াস' কথায়-কথায় হাসে না/ জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।/ ইংলিশে ও 'রাইমস' বলে 'ডিবেট' করে, পড়াও চলে/ আমার ছেলে খুব 'পজিটিভ' অলীক স্বপ্নে ভাসে না/ জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না। আসলে এমনই হয়ে পড়েছে আমাদের ভাষা। যেখানে আমরা নিজেরাই এখন অন্যভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে, এই আমাদের জন্যই কি ৫২'র ভাষা আন্দোলন হয়েছিল! বড় অদ্ভুত আমরা বাঙালি জাতি। আজ আমরা আমাদের ভাষা ভুলে যেতে বসেছি। একটু অতিশিক্ষিত হলে ইংরেজি আর শিক্ষিত না হলে আঞ্চলিক ভাষা। শুদ্ধ বাংলা আমরা খুব বেশি মানুষ বলিও না। শুধু তা-ই নয়, আমরা এখন আমাদের সংস্কৃতিটাও পরিবর্তন করে ফেলেছি। বাংলা ভাষার সংস্কৃতি, বাংলা সিনেমা, বাংলা নাটক, বাংলা গান, বাংলা গল্প, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস এমনকি বাংলা প্রবন্ধও আমাদের কাছে এখন বিরক্ত লাগে। আমরা ইংরেজি উপন্যাস আর তামিল সিনেমা দেখি। আর বেশি আধুনিক হলে হলিউড ছাড়া কিছুই দেখি না। আর রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের চেয়ে আমাদের কাছে শেক্সপিয়রের বই বেশি গ্রহণযোগ্য। এমনটাই এখন বাংলার চিত্র। আসলে এটা আমার আপনার একার কারণে নয়- এটা আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থার কারণে। আমরা অন্য সংস্কৃতি আমার দেশে প্রবেশ করতে দিয়েছি। অথচ আমার দেশের সংস্কৃতি অন্য কোথাও প্রবেশ করাতে পারি না। আমরা আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের দেশের চ্যানেল হাতেগুনে যা পাবো তার দিগুণ পাব বিদেশি চ্যানেল। যার কারণে ছোট ছোট ছেলেরা এখন বিদেশি চ্যানেল এবং ওই ভাষাতেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। আমি আর কারও কথা বলবো না। আমার ঘরেই আমার ছোট ভাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আলাদিন এবং মোটো-পাতলু নামক দুটি অনুষ্ঠান দেখে। দুটোই হিন্দি ভাষার। তাই এখন সে বাংলায় অনুষ্ঠান দেখালে দেখতে চায় না। তার রুচি এখন হিন্দিতে চলে গেছে। আমরা ছোটবেলা শুক্রবার বসে থাকতাম বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। খেলতে যেতাম না। অথচ এখন আমার ছোট ভাইদের বাংলা সিনেমা তো দূরের কথা- বাংলা চ্যানেল দিতেও দেখা যায় না। এই যে বাংলার প্রতি অনীহা এবং অবহেলা। এর কারণ কি? এমন হতে থাকলে আগামী প্রজন্ম এই ভাষাকে নিয়ে গর্ব অহংকার করতে ভুলে যাবে। এই মাস বইয়ের মাস। অমর একুশে বইমেলাসহ সারা দেশে এই মাসে বিভিন্নভাবে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার বই এই মাসে পাবলিশ হয়। লেখকরা তাদের সেরা লেখাগুলো নিয়ে বই বের করে মেলায়। যা পাঠকরা কিনবে এবং পড়বে। তবে সেই পাঠকরাও এখন আর নেই। এখন পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বর্তমান সময়ে পাঠকের চেয়ে বেশি আছে লেখক। যার কারণে লেখকরাই লেখকদের বই কিনছে। আর পরিচিত ছাড়া খুব বেশি অন্যকারও বই কেনা হয় না। বিশেষ করে নতুন লেখকদের বই তো লেখকের বন্ধু এবং পরিবারের লোকজন ছাড়া কেউ কেনেও না। হাতেগোনা নামকরা কয়েকজন লেখকের বই পাঠকরা কেনে। এ ছাড়া যার যত বেশি পরিচিত লোক রয়েছে তার ততবেশি বই বিক্রি হয়। এ ক্ষেত্রে বইয়ের মান যাচাই করতে হয় না। তবে এসবের চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে ভাষা। আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মান করলে, এসব আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রয়োজন বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে সবকিছু করা। বাংলার সঙ্গে যেন অন্যকোনো ভাষা মিশ্রিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলা আমাদের গর্ব, বাংলা আমাদের অহংকার। আজহার মাহমুদ প্রাবন্ধিক: কলাম লেখক