ইউরোপ-ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ও বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে বিশ্ব রাজনীতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পর কমনওয়েলথকে সচল করে বিশ্বপ্রভাব তৈরি করা কঠিন। 

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
পুরো বিশ্বে উগ্র জাতীয়তাবাদের যে উত্থান চলছে তার সর্বশেষ নিদর্শন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়া ব্রেক্সিট নামে পরিচিত। ২০১৬ সালে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবে ব্রিটেন। গণভোটে ৫১.৯% ভোট ব্রেক্সিটের পক্ষে থাকলেও ৪৮% ভোট পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে। এটাই হয়তো গণতন্ত্রের অন্যতম সংকট। সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বলে বড় একটি বড় অংশের মতকে খারিজ করে দেওয়া হয়। ব্রেক্সিটপন্থিদের যুক্তি হচ্ছে পূর্ব ইউরোপ থেকে দলে দলে অভিবাসী এসে ব্রিটেনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ব্রিটেনের স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় রাখতে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যেতে চায়। তারা মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কারণে তাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ব্রেক্সিট ইসু্যকে কেন্দ্র করে গত তিন বছরে তিনজন প্রধানমন্ত্রী আসছে ব্রিটেনে। সর্বশেষ বরিস জনসন ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে পাস করে আসেন। ১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ব্রেক্সিট কার্যকর হলেও আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর অন্তর্বর্তীকালীন সময় যাবে। এই সময়ে বাণিজ্য সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে- তবে ইউরোপের কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্রিটেন অংশ নিতে পারবে না। অবশ্য এই সময়টাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিলে অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে জনসন সরকার ইউরোপীয় ২৭ দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে কোনো ভ্যাট যুক্ত হবে না। চালু থাকবে হেলথ ইন্সু্যরেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও টুরিস্ট পারমিট। ইউরোপের অন্যান্য দেশে বসবাসরত ব্রিটিশ নাগরিকদের পেনশনও চালু থাকবে। তবে ব্রেক্সিট কার্যকর হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট থেকে ৭৩ ব্রিটিশ এমপি তাদের পদ হারাবেন। ব্রিটেনের ঘরোয়া রাজনীতিতে ব্রেক্সিটের তেমন প্রভাব পড়বে না। কারণ ইংলিশ চ্যানেলে এপারে খুব একটা ইউরোপের প্রভাব আসতে দেয়নি ব্রিটিশরা। ৪৭ বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পথ চললেও ব্রিটেন তাদের মুদ্রা ও ভিসাকে আলাদাই রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেবলই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জোট না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপ হয়ে ব্রিটেনের পরিচিতিটা দীর্ঘদিনের। ফলে ব্রেক্সিটপন্থিরা যেভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরির কথা বলছে তা পুরোপুরি মিলবে না। ব্রেক্সিট স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের অবাধ বাণিজ্যে একটা প্রভাব ফেলবে। ফলে সাময়িক সংকটে পড়তে পারে ব্রিটেনের অর্থনীতি। ব্রিটেনের বাইরে গেলে মোবাইল সিমে যে রোমিং সুবিধা পাওয়া যেত সেটা বন্ধ হয়ে গেলে তাও একটা প্রভাব ফেলবে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। ব্রিটেন ইউরোপ থেকে ভূখন্ডগত বিচ্ছিন্ন হলেও উত্তর আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত বাণিজ্যে ইতোমধ্যে টান পড়ছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো খবর ছাপিয়েছে।  বাংলাদেশ থেকে ৯০-এর দশকে ব্রিটেন পাড়ি দেওয়া শিক্ষিক তরুণ ও উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা সবেমাত্র তাদের ব্যবসাকে ইউরোপের অন্য দেশে প্রসারিত করছিল। ব্রেক্সিট তাদের বাণিজ্যে একটা প্রভাব ফেলবে। এখন তাদের হয় ব্রিটেনমুখী হতে হবে নতুবা ব্রিটেন ছাড়তে হবে। ব্রিটেনের মানবাধিকার, অভিবাসন সংক্রান্ত আইন মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কারণে শিথিল। ফলে অভিবাসন সংক্রান্ত আইনে কঠোরতা আনতে পারে ব্রিটেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে চার বিলিয়ন ডলারের পণ্য ব্রিটেনে রপ্তানি করে বাংলাদেশ। তার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্রিটেন থেকে আমদানি করে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ ব্রিটেন। বিশ্বের নানা দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠায় আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে ব্রিটেন। বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ। ফলে ব্রিটেনের নতুন বাণিজ্যিক পলিসির দিকে নজর থাকবে বাংলাদেশের। যদিও বা ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন বলেছেন, 'ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের মধ্যে বাণিজ্য, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।' স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি ক্ষেত্রে শূন্য শুল্ক সুবিধা পায় বাংলাদেশ। হাইকমিশনার বলেন, 'ইইউ থেকে বাংলাদেশ যেমন শূন্যশুল্ক সুবিধা পায়, ব্রিটেন থেকেও একই সুবিধা লাভ করবে বাংলাদেশ।' ফলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগও বাড়তে পারে। ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বে ন্যাটোতেও। বহুদিন ধরে ন্যাটোর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে জার্মান ফ্রান্সের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতনৈক্যের ফলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতের দিকে যাচ্ছে। বেক্সিট সে অনিশ্চিয়তা বাড়াবে। নির্বাচিত হয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষয়িষ্ণু জোট ও সময়ের বিবর্তনে তা ভেঙে পড়বে বলে মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেক ব্রিটেনের পর আরও দেশ বের হয়ে যাবে বলে ট্রাম্প ভবিষ্যৎ বাণীও করেছিলেন। এর আগে ইউরাপীয় ইউনিয়নকে বাণিজ্য শত্রম্ন ও ন্যাটো সামরিক জোটকেও পুরনো ও অচল বলে আখ্যায়িত করেন। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বন্ধুরাষ্ট্র ব্রিটেনের সরে যাওয়ার ফলে মার্কিনিদের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়বে। ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে বিশ্ব রাজনীতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পর কমনওয়েলথকে সচল করে বিশ্বপ্রভাব তৈরি করা কঠিন।  শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন: কলাম লেখক