সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হোক

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে নিতে পারলে হাজার হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁস সহজেই বন্ধ হবে, কাজেই এই মহতী উদ্যোগে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

এম এ কাদের
আমাদের দেশে অপরিকল্পিত ভর্তি পরীক্ষার কারণে অযথা শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও মানসিক চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তা ছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত কোচিং বাণিজ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বই ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্যে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত শিক্ষার সুফল আমরা পাচ্ছি না। শিক্ষাই যেখানে জাতির মেরুদন্ড সেখানে অপরিকল্পিত, দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে এত তাচ্ছিল্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার শেষে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী ঢাকায় কোচিং সেন্টারগুলোতে অংশগ্রহণ করে থাকে। এতে করে ঢাকা শহরে অবস্থানের জন্য বাড়তি চাপ অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। তা ছাড়া মেয়েদের জন্য নিরাপদ মেস (আবাসস্থল) পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক মহিলা মেসে তদারকিতে অসৎ, খারাপ মহিলা থাকার কারণে কোচিং করতে যাওয়া কোমলমতি নিষ্পাপ মেয়েদের ফুঁসলিয়ে বা ভয়ভীতি অথবা বিষয়টি গোপন রেখে বেড়াতে নিয়ে যেয়ে সম্ভ্রমহানী করার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে, পরিকল্পিত নিয়ম না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী সব ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। অনেক সময় একইদিনে বা পরের দিন কয়েক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা হয়ে থাকে। যেমন: আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরের দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, তার পরের দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, তার পরের দিন বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা হয়ে থাকে- যা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দৌড়াদৌড়ি করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কোনভাবেই সম্ভব হয়ে উঠে না। ভর্তি পরীক্ষায় বর্তমান নিয়ম অবশ্যই পরিবর্তন এনে শিক্ষার্থী অযথা হয়রানি ও মানসিক চাপ থেকে বাঁচাতে হবে। এই হয়রানি বন্ধের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পনের দিনের মধ্যেই জয়েন্ট ইনট্রান্স পরীক্ষার নামে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে মেধা অনুযায়ী সিরিয়ালের মাধ্যমে ভর্তি নিশ্চিত করে থাকেন। এই পদ্ধতি আমাদের দেশে অনুসরণ করা যেতে পারে বা আমাদের দেশে বর্তমান মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার মতো পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। একই নিয়মে কৃষি বিষয়ে সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা, সব ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা, সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এই ভর্তি পরীক্ষাগুলো বিরতিহীনভাবে প্রত্যেক দিন এক একটি করে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থীদের স্থান ত্যাগ, ছোটাছুটি, যাতায়াত ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাবে। এই ভর্তি পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে নিতে পারলে ভর্তি কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। অথবা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দৌড়াদৌড়ি হয়রানি ছাড়া মেধা যাচাইয়ে সঠিক পথে বের করে মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রকাশ থাকে যে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর মূল পরীক্ষা অর্থাৎ এসএসসি এবং এইচএসসি ফল প্রকাশ হলে উভয় পরীক্ষার নম্বর যোগ করে মেধা অনুযায়ী ভর্তির ফল প্রকাশ করা যেতে পারে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য কোচিং বাণিজ্য একটি বড় বাধা। ইদানীং বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজের ক্লাস না করে কোচিং, টিউশনি প্রাইভেট পড়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। সরকার যেখানে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেটের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে চায়, তখনই অধিক ক্ষমতাধর অপশক্তি কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। কারণ কোচিং বাণিজ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগে হাতিয়ে নেয় হাজার হাজার কোটি টাকা। তা ছাড়া এ কোচিং সেন্টারগুলো বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা মূলত দুর্নীতির কারণেই এগিয়ে যেতে পারছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতিকে নিঃশেষ করার জন্য জিরোটলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই নীতি বাস্তবায়ন হলেই শিক্ষাব্যবস্থায় দলমতনির্বিশেষে সঠিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ হবে। সৎ, যোগ্য মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। এদের দ্বারা পাঠদানেই শিক্ষার্থীরা ক্লাস অভিমুখে আবার ফিরে আসবে। শিক্ষা কারিকুলাম অবশ্যই বিচার বিশ্লেষণ করে সব বিষয়ে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করতে হবে। অতিরিক্ত বইয়ের চাপ কমিয়ে খেলাধুলার মাধ্যমে পড়াশুনা আনন্দের হতে হবে। যে কোনো মূল্যে প্রশ্নফাঁসকারীদের দলমতনির্বিশেষে কঠিন হাতে দমন করতে হবে। দমনে ব্যর্থ হলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হবে, অন্যদিকে অদক্ষ, অযোগ্য মেধাশূন্য শিক্ষার্থীরা অধিক গুরুত্বপূর্ণস্থান দখল করে সঠিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যর্থ হবে। এ কারণে জাতি মেধাশূন্য হয়ে দেশ অনেক পিছিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশ এবং জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থা দলমতনির্বিশেষে কোনোভাবেই অনিয়ম, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই রক্ষক যেন ভক্ষক না হতে পারে। মনে রাখতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দেশ এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। ভর্তি পরীক্ষার অযথা হয়রানি নিয়ে নিরসনের জন্য, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গত ২৩/০১/২০২০ তারিখে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে উপচার্যরা বৈঠক করে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভূমিকা সাধুবাদযোগ্য। উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এই পদ্ধতির পক্ষে কথা বলেন, তখন থেকেই ইউজিসি এ বিষয়ে বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা চালায়। গত ২৫/০১/২০২০ তারিখে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. কাজী শহিদুলস্নাহ জোর দিয়ে বলেছেন, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর অযথা হয়রানি, অর্থব্যয়, সময় অপচয় ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে নিতে পারলে হাজার হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁস সহজেই বন্ধ হবে, কাজেই এই মহতী উদ্যোগে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। এম এ কাদের: কলাম লেখক