মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিব শতবর্ষ: যথার্থভাবে পালন-প্রত্যাশায় রণেশ মৈত্র

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন একের পর এক। নির্বাচনের দাবিতে, বন্দিমুক্তির দাবিতে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে, সামরিক শাসনের অবসানের দাবিতে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে, ছয়দফা-এগারো দফার দাবিতে, আবারও নির্বাচনের দাবিতে, নির্বাচন পরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে, অতঃপর অসহযোগ এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
নতুনধারা
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে তার জন্মের ক্ষণগণনা। ১৭ মার্চে তার জন্মদিন এবং শততম জন্মদিন। দিনটি পরম আনন্দের এবং বাঙালি জাতির জীবনেও অজস্র ঐতিহাসিক স্মৃতিবহ।

১৯২০ সালের ১৭ জানুয়ারি সাবেক ফরিদপুর বর্তমানের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেন। কে জানতো সেদিনের ওই শিশুটি একদিন মহীরুহে পরিণত হবে এবং ইতিহাসে মহানায়ক হিসেবে অবিহিত হবে।

আমরা যারা তাকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছি বা নানাভাবে তার সাহচর্য পেয়েছি আজকের প্রজন্মের জীবনে সে সুযোগ ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিদায় ঘটে মর্মান্তিক এক হত্যালীলার শিকার হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর রাতে। তার পর আজ ৪৫ বছর অতিক্রান্ত। সুতরাং যে কোনো হিসেবেই বলা যায়, যাদের বয়স আজ ৬০ বছর তারাও হয়তো তাকে দেখেননি- তার কার্যকলাপ যে প্রত্যক্ষ করেননি- তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে যে গ্যাপের বা শূন্যতার বা ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর করে উভয়ের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টিই হওয়া উচিত এবং তা করতে হলে তার জীবনী আলোচনা, তার কর্মজীবন, শিক্ষা জীবন, পারিবারিক জীবন কারজীবন প্রভৃতি নিয়ে, বা এই প্রতিটি সময়কাল ও তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে সর্বত্র যেমন সত্যনিষ্ঠ আলোচনা হওয়া দরকার, তেমনই, বা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার তার জীবনাদর্শ কি ছিল এবং সেই জীবনাদর্শ বাস্তবায়নে তিনি কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং আমরা তার ওই আদর্শগুলিকে রাষ্ট্রীয়, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কতটা লালন করছি এবং কতটা বাস্তবায়ন বাকি আছে এবং কত দ্রম্নত আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই এবং সে লক্ষ্যে আমরা কোন পথে অগ্রসর হবো।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক নিয়ে সত্যনিষ্ঠ আলোচনা ব্যাপক ভিত্তিতে এবং সব পর্যায়ে আরও করা দরকার এ কারণে যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে একটানা একুশ বছর ধরে সামরিক-আধা সামরিক বা বেসামরিক যে সব সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৈধ বা অবৈধ পন্থায় দখল করেছিলেন তারা বেমালুম সত্যের পথে না থেকে বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির পরিচালিত গণ আন্দোলনগুলোর, নির্বাচনী ব্যবস্থাবলির ও বঙ্গবন্ধুর অবদানগুলোর যে বিকৃতি সাধন করেছিলেন, ইতিহাস বিকৃতির যে বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তার পরিণতিতে আজ যাদের বয়স ৬০ বছর পর্যন্ত তাদের প্রায় সবাই ওই বিকৃত, অসত্য ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের এবং তার জাতির জনকের ভূমিকা ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃতভাবেই জেনেছেন ও লিখেছেন।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, ওই শিক্ষা নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নামিদামি ডিগ্রি নিয়ে যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষাদান করেছেন বা আজও করছেন তাদের থেকেও ওই বিকৃত ও অসত্য শিক্ষা সম্ভবত আজও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চালু আছে।

তাই আমরা এক গভীর ও বিশাল দায়িত্বের মুখোমুখি। বঙ্গবন্ধুকে সমগ্র দেশের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা, তার জীবন, তার সংগ্রাম, তার বিজয়, তার ভুল-ত্রম্নটি, তার সাহস, তার অবদান, তার আদর্শ এবং সব কিছু। কারণ আমরা তার কাছে, ইতিহাসের কাছে এবং সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে রীতিমতো দায়বদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিশাল ক্যানভাস এই নিবন্ধে তুলে আনা আমার লক্ষ্য নয়। আর অত বড় দায়িত্ব পালনের সামর্থ্যও আমার নেই-সে যোগ্যতাও নেই।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক এবং অবিভাজ্য। এমন কথা আমরা হামেশাই বলে থাকি শুনেও থাকি? কিন্তু বলার সময় একটি বারও কি আমরা ভাবি, কেন তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের অখন্ড অস্তিত্ব বজায় না রেখে স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? পাকিস্তানের সঙ্গে তার স্বপ্নের বাংলাদেশের কি পার্থক্য রচনা করতে চেয়েছিলেন?

মনে রাখা দরকার, তিনিও তাদেরই একজন যারা পাকিস্তান নামক মুসলমান রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন এবং তার জন্য, অপরাপর অনেকের সঙ্গে তিনিও প্রচন্ড পরিশ্রম করেছিলেন যদিও তিনি তখন একজন কিশোর কলেজ পড়ুয়া এবং শহিদ সোহরাওয়ার্দীর (মুসলিমলীগ নেতা তৎকালের) একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে। তিনিও মুসলিম লীগেরই কর্মী ছিলেন। ১৯৪৭-এর আগস্টে তার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণও হয়েছিল।

অবশ্য একথাও সত্য, মুসলিম লীগের সব নেতাকর্মীর সঙ্গে এক করে বঙ্গবন্ধুকে ভাবলে এক হবে না। কোনো সাম্প্রদায়িক চিন্তা বা কোনো ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা তাকে কদাপি গ্রাস করেনি। বরং তিনি যখন দেখেছিলেন, হিন্দুরা বেশি শিক্ষিত, বেশি আধুনিক, আর্থিকভাবে বেশি উন্নত আর মুসলিম সমাজ প্রায় অশিক্ষিত, অনাধুনিক এবং পশ্চাৎপদতায় আচ্ছন্ন এবং চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার তখন উভয় সম্প্রদায়কে সব দিক থেকে বৈষম্যমুক্ত করার লক্ষ্য থেকেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করেছিলেন।

কিন্তু পাকিস্তান নামক ওই আকাঙ্ক্ষিত তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বছর যেতে না যেতেই, মাত্র কয়েকমাস পরেই তিনি বুঝে ফেললেন, পাকিস্তান তার আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে আসেনি। বরং রাষ্ট্রটি একেবারেই বিপরীত ধর্মী এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া এবং পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়ে পাকিস্তান অর্জন সম্ভব করে তুললেও, বাঙালি মুসলমানদের (তথা সমগ্র বাঙালি জাতির) স্বার্থবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পাকিস্তান।

তখন তিনি এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি তরুণরা ১৯৪৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নকর্মচারীদের স্বল্প বেতন ও অন্যান্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরিণতিতে তাদের জেল-জীবন শুরু হয়।

অতঃপর ১৯৪৮ ও ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। জেল থেকেই তিনি তার প্রতি সমর্থন জানান। একই সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন- ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন একের পর এক। নির্বাচনের দাবিতে, বন্দিমুক্তির দাবিতে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে, সামরিক শাসনের অবসানের দাবিতে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে, ছয়দফা-এগার দফার দাবিতে, আবারও নির্বাচনের দাবিতে, নির্বাচন পরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে, অতঃপর অসহযোগ এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

এক নিমেষে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১-এর মূল আন্দোলনগুলোর কথা উলেস্নখ করা হলেও প্রতিটি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস। এই ইতিহাসের স্রষ্টা বাংলাদেশের সংগ্রাম। কথাটি শুধু তাত্ত্বিক তা নয় পুরোদস্তুর বাস্তবও।

ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে এসে নেতৃত্বের মধ্যমণির আসনে অধিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের মাটিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্বের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় স্থান গ্রহণ করেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ, শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, তাজউদ্দীন আহমদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখও। বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে এসে প্রধানতম নেতায় পরিণত হয় এবং পূর্বোলিস্নখিত নেতাদের অবদানও বঙ্গবন্ধুকে ওই পর্যায়ে আনতে কোনোক্রমেই কম ছিল না।

আবার আওয়ামী লীগ আন্দোলনগুলোর প্রধান শক্তি হলেও একক শক্তি ছিল না। সেখানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গোপন (বেআইনি হওয়ার কারণে) কমিউনিস্ট পার্টির অবদানও সব আন্দোলন সংগ্রামে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের অবদান ও ঐতিহাসিক। বস্তুত বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বামপন্থি শক্তিগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে এবং পরস্পর হাত ধরাধরি করে। উভয়শক্তিই তার ফলে পুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল লাভবানও হতে পেরেছিল। আজকের বামপন্থি শক্তিগুলোর দুর্বলতা দেখে অতীতকে ভাবলে ইতিহাস সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও এবং তা সঠিক ভাবনা হবে না। হবে এক ভুল ও বিকৃত ভাবনা।

বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন ভাষা আন্দোলনের ও অপরাপর আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং দলের বাম-অনুরাগী সভাপতি মওলানা ভাসানী ও অন্যান্য বামপন্থি আওয়ামী লীগ নেতারা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম শব্দ' তুলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ রূপান্তরিত করতে, দ্বিধাহীনভাবে তিনি সে কাজে উদ্যোগী হন।

পাকিস্তান সরকার যখন সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে 'ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান' করার উদ্যোগ নিল অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুও তার বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে বলেন, পাকিস্তান হবে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার মিলিত ও সমান অধিকার সম্পন্ন রাষ্ট্র।

এর আগে পাকিস্তান সরকার ওই একই লক্ষ্যে একবার উদ্যোগ নিয়েছিল পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে অর্থাৎ ধর্ম ভিত্তিতে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকবে এবং বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থীরা ওই আসনগুলোতে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন এবং ওই ধর্মবিশ্বাসীরা ওই প্রার্থীদের ভোট দেবেন। দেশের বামপন্থি শক্তিগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুও পৃথক নির্বাচন যুক্ত নির্বাচন চাই বলে দাবি-উত্থান করলেন।

ধাপে ধাপে আন্দোলন যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর যখন জীবনাবসন ঘটল এবং বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগের প্রধান এবং একক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হলেন, তখন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় (১৯৬৪) তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের কর্মসূচি দলীয় মেনিফেস্টোতে সন্নিবেশিত করেন এবং তিনি দলীয় সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

অতঃপর ১৯৬৬-তে ওই ছয় দফা এবং এগার দফা তারপর গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হন- দেশটাও দ্রম্নতই মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে ওই দাবির মূর্ত প্রতীকে পরিণত হন।

যেদিন তাকে 'বঙ্গবন্ধু' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল সমাবেশে সমগ্র বাঙালি জাতি আবেগাপস্নুত চিত্তে তাকে স্বাগত জানালেও, প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াত মুসলিম লীগ মহল তার 'জয় বাংলা' স্স্নেস্নাগানকে আখ্যায়িত করে ভারত ভুক্তির বা দুই বাংলা এক করার নির্দেশিকা হিসেবে। কিন্তু ওই অপপ্রচার তাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি- তিনি একদিকে যেমন বাঙালির স্বার্থের কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন, তেমনই আবার ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশী সুলভ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথাও সমভাবে বলেছেন। সমমর্যাদার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছেন। প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলো জনমতের কাছে পরাজিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের অঘোষিত পথে দেশটি অগ্রসর হতে থাকে। এর জন্য তাকে 'ইসলামিক রিপাবলিক বর্জন', ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি সর্বদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।

১৯৭০-এর নির্বাচন এলো প্রবল আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভু্যত্থানকে স্মরণে রেখে। নির্বাচনী পোস্টারে ব্যবহৃত হলো না 'বিসমিলস্নাহ' বা অন্য কোনো ধর্মীয় ইঙ্গিত। শুধু দল, দলীয় প্রতীক ও প্রার্থীর নামে মাত্র কয়েক হাজার পোস্টার। প্রার্থীরা আর্থিক সামর্থ্যহীন কয়েক হাজার লিফলেট আর ইউনিয়নগুলোতে একটি করে জনসভা। ব্যস জনগণের বিপুল ভোটে বিজয় সামান্য দুই-তিন হাজার টাকা ব্যয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো পাকিস্তানকে আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সশস্ত্র সহযোগিতা পরাজয় নিশ্চিত করে। শুধু পাকিস্তানকে পরাজিত করা হয়নি- পরাজিত করা হয়েছিল তার আদর্শিক অবস্থানকে। অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী চেতনাকে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুও হয়েছিল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে যা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টাক্ষরে ঘোষণা করে ছিলেন।

তেমনই আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশের সংবিধান রচিত ও অনুমোদিত হলো যাতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলো- নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ ও ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য হিসেবে বর্ণিত হলো।

এই বিশাল ইতিহাস, বিশাল কর্মকান্ডকে স্মরণ, কথায় ও কাজে তার বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র ও সমাজকে সেভাবে গড়ে তোলা, সম্পদ মুষ্টিমেয়র হাতে পুঞ্জীভূত করা নয় বরং নিষ্ঠার সঙ্গে তার সুষম বণ্টন এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার কর্মসূচি সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়ার দাবিকে তীব্র করে তুলে তাকে পুনরায় সর্বজনীন দাবিতে পরিণত করতে পারলেই কেবল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন যথার্থ এবং ফলপ্রসূ হতে পারে শুধু নানাবিধ জলুস প্রদর্শন ও আবেগঘন বক্তৃতা ভাষণে বা মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে নয়। সেগুলো থাকবে তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে অগ্রসর হয়েই ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে, নতুন করে গজিয়ে ওঠা জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোর সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত প্রস্তাবে স্মরণীয় করে তুলতে পারি- তাকে যথার্থভাবে সম্মান দেখাতে পারি।

তাই দ্বিধা-সংকোচ পরিত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাস মার্চের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা ভালো হয় ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আগ দিয়ে

এক. সংসদের অধিবেশনে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে ১৯৭২-এর বঙ্গবন্ধু প্রণীত মূল সংবিধানের পুনরুজ্জীবন ঘটানো;

দুই. রাষ্ট্রে যেহেতু সব ধর্মাবলম্বীরা সমান অধিকার এবং রাষ্ট্রটি যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ তাই বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক ও গণতন্ত্রের বিধান অনুসরণ করে 'বিসমিলস্নাহ' অপসারণ ও জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামসহ সব ধর্মাশ্রয় দলকে বেআইনি ঘোষণা করা;

তিন. যে সব মন্দির, মসজিদ, গির্জা প্যাগোডা প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ভাংচুর বা বিনষ্ট করা হয়েছে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল অবধি তার জন্য দায়ী দলমত নির্বিশেষে সব সন্ত্রাসীকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট মোকর্দমা দায়ের করে বিশেষ ট্রাইবু্যনালে তাদের বিচার কঠোর শাস্তি প্রদান ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা এবং

চার. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী ডিজিটাল মামলা, সব বয়াতিসহ যারাই এজাতীয় আইনে আটক আছেন, অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও বিনাশর্তে মুক্তিদায়ের ব্যবস্থা করা হোক।

দেশের সব বুদ্ধিজীবী, সব মুক্তিযোদ্ধা সব শিক্ষক-আইনজীবী-নারী-ছাত্র যুব সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো উপরোক্ত দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং মুজিব শতবর্ষ উপযুক্তভাবে উদযাপনে এগিয়ে এসে এই বর্ষটিকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় উৎসবে পরিণত করুন।

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<87625 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1