কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ কেন প্রয়োজন

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মো. সাজেদুল ইসলাম ঢাকা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে সম্প্রতি বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালন করা হয়। কুষ্ঠরোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে এই বছর ওই দিবসটি পালনের গুরুত্ব রয়েছে, কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কুষ্ঠ সম্মেলনে বক্তৃতাকালে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কুষ্ঠ আমাদের জাতীয় দুর্ভোগের কারণ। এর কারণে জনগণের একটি অংশ তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে অথবা ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছে। কুষ্ঠকে ঘিরে কুসংস্কার বিরাজ করায় তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন ও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, আরোগ্য লাভ এবং সামাজিক কার্যাবলি ব্যাহত হয়। এর ফলে সমাজে ও পরিবারে রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানব সভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব একবারেই কমে এসেছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে। প্রতি বছর প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ নতুন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে শনাক্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় ৮-১০% সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন সংক্রামক ধরনের রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙ্গুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এই রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানা গুটিও দেখা দেয়। কুষ্ঠ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। দরিদ্রতা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো-বাতাসের অভাব ইত্যাদি এই রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। বিকলাঙ্গতাই হচ্ছে কুষ্ঠজনিত সব সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার প্রধান কারণ। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসায় আসা অতীব জরুরি প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য। কুষ্ঠরোগ প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে কুষ্ঠ নির্মূলের ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এই খাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বাজেট স্বল্পতার কারণে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী খুঁজে বের করার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব, এই রোগকে ঘিরে কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব আছে। চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে ধারণা কম থাকায় রোগী চিহ্নিত করা ও চিকিৎসা কাজে ব্যাহত হয়, দেশের সর্বত্র চিকিৎসা সুবিধা সমানভাবে প্রাপ্তিসাধ্য নয়, এবং দেশে কুষ্ঠের কারণে বিকলাঙ্গদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাব। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, আরোগ্যলাভ এবং সামাজিক কার্যাবল ব্যাহত হয়। রোগী শনাক্তকরণের জন্য মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় কর্মচারী নেই। আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে কুষ্ঠরোগ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পাঠদান করা হয় না বলে জানা যায়। বাজেট স্বল্পতার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশে কুষ্ঠের বিশেষায়িত সেবা খুবই অপ্রতুল। কুষ্ঠরোগীদের সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশে তিনটি সরকারি কুষ্ঠ হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালগুলোর পূর্ণাঙ্গ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কুষ্ঠ বিষয়ে অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম চালানো দরকার, প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই রোগ এককভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। দেশে কুষ্ঠজনিত সব প্রতিবন্ধী লোকজনের সঠিকভাবে সামাজিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন যেন তারা সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বাস করতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব। সব ধরনের বৈষম্য ও কুসংস্কারের অবসান ঘটিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন করা দরকার যাতে তারা সক্রিয়ভাবে কুষ্ঠ সেবার বিষয়ে অংশ নিতে পারে। আক্রান্তদের ও তাদের পরিবারের জন্য জীবিকার্জনে সাহায্য করা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত 'কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০' পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে অধিকার কর্মীরা মনে করেন। ওই পরিকল্পনায় কুষ্ঠ ও এর জটিলতা দূর করা, বৈষম্য দূর করা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করা, সময়মতো রোগী শনাক্তকরণে গুরুত্ব দেওয়া, এবং পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জনগণকে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে এমন একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা দরকার সেখানে কুষ্ঠরোগীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে এবং সামাজিকভাবে সব সুযোগ-সুবিধাগুলো উপভোগ করতে পারে। কুষ্ঠ বিষয়ে গণমাধ্যমের ইতিবাচক বার্তা প্রচার এই রোগ নির্মূল কার্যক্রমকে গতিশীল করতে পারে। কুষ্ঠ রোগ জীবাণু দ্বারা হয়, অভিশাপ নয়। নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে এই রোগে আক্রান্তরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য সমান স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যাতে নিশ্চিত হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় বার্তা প্রচার করা উচিত। কোথায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সে বিয়য়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত বার্তা এই রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কুষ্ঠ বিষয়টা যেন গুরুত্ব পায় সে বিষয়েও গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা থাকা উচিত। আমাদের একযোগে অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। কারণ এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত রেখে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কুষ্ঠরোগাক্রান্ত প্রতিবন্ধী মানুষের পুনর্বাসন এবং সঠিক যত্নের জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। যেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিপূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারেন। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীরা দেশের বোঝা নয়, তাদেরও রয়েছে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার। আমাদের জাতীয় সংবিধানে প্রতিটি নাগরিক এর সমান সুবিধা নিশ্চিত করে। তাই কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। আসুন আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রে কাজ করি এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই। বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস উপলক্ষে লেপ্রোসি অ্যান্ড টিবি কো-অর্ডিনেটিং কমিটি (এলটিসিসি) এবং জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচির যৌথ আয়োজনে রাজধানীতে সম্প্রতি এক আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্যর্ যালির আয়োজন করা হয়। মহাখালীতে অবস্থিত লেপ্রোসি কন্ট্রোল ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভায় বক্তৃতাকালে বক্তারা কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনের জন্য- সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা এবং সভাপতিত্ব করেন পরিচালক, এমবিডিসি ও লাইন ডিইরেক্টর, টিবিএল অ্যান্ড এএসপি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম। থমাস সিংহ, প্রোজেক্ট ম্যানেজার, লেপ্রা বাংলাদেশ, অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন। আলোচনা সভায় বক্তারা কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বক্তারা বিভিন্ন পর্যায়ে কুষ্ঠ বিষয়ে সচেতনতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেন যা বিভিন্নভাবে করা উচিত বলে তারা মনে করেন। অধিকারকর্মীরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা আশা প্রকাশ করেন যে, ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে।