বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাবা-মাকে ভরণপোষণ না দিলে কারাদন্ড

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ ঢাকা
  ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সব ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকে; কিন্তু সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসার মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে সন্তানদের সুখী করতে চান। শিশুর বয়স বেড়ে ওঠার পর বাবা-মায়ের দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মা তার সন্তানদের লেখাপড়ার অভ্যন্তরীণ সর্বদিকে দৃষ্টি রাখেন আর বাবা তাদের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থসংক্রান্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে তাদের যদি কিছু অসুবিধা হয়েও থাকে তা তারা সন্তানের মুখ পানে চেয়ে হাসিমুখে বরণ করে নেন। সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ছে কিনা, আদব-কায়দার বরখেলাপ করে কিনা এ সব দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন 'মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত'। সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের চাওয়া-পাওয়ার শুধু একটাই- যা হলো সুসন্তান হয়ে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করা। যদি কোনো সন্তান সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সুনাম অর্জন করতে পারে তাহলে বাবা-মায়ের আনন্দের সীমা থাকে না। সব বাবা-মা-ই চান তার সন্তান শিক্ষিত, আদর্শবান ও চরিত্রবান হয়ে সমাজে দশজনের মুখে প্রশংসিত হোক। সুতরাং এমন পরম হিতৈষীর জন্য আমাদেরও করণীয় রয়েছে। তাদের সেবাযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রম্নটি করতে নেই। বাবা-মা যেন নিজেদের উপেক্ষিত বলে মনে না করতে পারেন তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। যাদের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসায় আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তারা কর্মক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে বাবা-মাকে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য আদালতে যেতে হচ্ছে। প্রবর্তিত জীবনযাত্রার মানুষের মানসিক মূল্য এবং চিন্তাধারার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের জীবনযাত্রার এক অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পরিবার একক পরিবার, মা-বাবা আর তাদের একজোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায়, যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্ততিরা এক নিজস্ব মনোজগৎ সৃষ্টি করে নেয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়েছে কষ্টকর সময়। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। যা হওয়া উচিত নয় বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। লক্ষণীয় তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি, সন্তান উচ্চ শিক্ষিত, ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কিন্তু বাবাকে তার ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে আপমানের গস্নানি নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রম নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নিজ পরিবারে। পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বাধ্যকারী নির্দেশনা আছে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন ও নবীজীর হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বহুবার বহুভাবে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। মহান আলস্নাহ বলেন 'আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের 'উহ' শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না, আর তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বলো, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভালো করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল'। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ীও বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিতে সন্তান বাধ্য থাকবে। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো বাবা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। অবহেলিত বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট লাগব করার জন্য সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে বাবা-মায়ের ভরণপোষণ আইন-প্রণয়ন করে। বাবা-মায়ের ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন। আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণপোষণ করতে হবে না। ওই আইনের ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তার সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। সবশেষে বলব, শুধু আইন দিয়ে এ অমানবিক বিষয় রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় অনুশাসনও মেনে চলা। আমাদের সবারই বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পরায়ণ হওয়া উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<87751 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1