বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার মান

সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ড ও অসহনীয় আচরণ ঘটছে, তা সত্য-সত্যই কলঙ্কজনক। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, তবে এখনো শিক্ষার মান বাড়েনি। গবেষণামূলক কর্মকান্ডে স্থবিরতা এসেছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডকে এখন কী বলে অভিহিত করা হবে তা বলা দুষ্কর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণামূলক, সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের সুফল জাতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোগ করছে না। একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থানে আছে। উদ্ভাবন প্রক্রিয়া অগ্রসরমান রয়েছে।
ডা. এস এ মালেক
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাহলে তা সহজে জনগণ জানতে পারেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যতই চেষ্টা করুক না কেন দুর্নীতির ব্যাপারটা ঢাকা দিতে পারেন না। যিনি গোপনে উৎকোচ গ্রহণ করেন, তার ধারণা যেহেতু গোপনীয়ভাবে উৎকোচ নেওয়া হয়েছে, তা কেউই জানতে পারেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- যিনি উৎকোচ দেন, তিনি ঢোল পিটিয়ে উৎকোচের কথা না বললেও এমনভাবে উৎকোচ প্রদানের ঘটনা কাছের লোকের কাছে বর্ণনা করেন, যা ঢোল পিটিয়ে বক্তব্য রাখার শামিল। আমাদের ছোটবেলায় অর্থাৎ ৭০-৮০ বছর আগে বলা হতো পুলিশ, খাদ্য বিভাগ ও কাস্টমস দুর্নীতি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা বিচারালয়ে দুর্নীতি হয় এরূপ কথা শোনা যায়নি। ষাটের দশকে যখন আমি রাজবাড়ীতে একজন চিকিৎসক, তখন ওই শহরের একজন মুনসেফ সন্ধ্যার পর বাড়িতে কোনো আত্মীয় ঢুকতে দিতেন না। নিজে বাজার করতেন। কেননা, বাজার করার কোনো লোক ছিল না। বাসায় ছিল না কোনো কাজের বুয়া। এরপর সেশন জজ, বড় বড় ব্যক্তি ও এমনকি প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত ডাক্তার হওয়ার সুবাদে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু ৬০-এর দশকে ওই রাজবাড়ীর মুনসেফের মতো আদর্শের সৎচরিত্রের এমন একজন বিচারকের দেখা আর কখনো হয়নি। আমার প্রয়াত পিতাকে বহুবার বলতে শুনেছি যে, শিক্ষক ও বিচারপতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। তবে সত্য কথা বলতে কি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মতো আজ শিক্ষক ও বিচারক খুঁজে পাওয়া কঠিন।

কে না জানে যে, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে নিয়োগ দিতে তিন থেকে সাত লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। আর একজন পুলিশ কনসটেবলের চাকরিতে ঘুষের পরিমাণ আরও বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলছে অবাধে দুর্নীতি। শোনা যায়, একজন লেকচারার নিয়োগ দিতে ক্ষেত্রবিশেষে বিশ থেকে পঁচিশ লাখ টাকা গুনতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে উন্নয়ন কাজের কার্যাদেশ প্রদান সাপেক্ষে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য নিয়ে থাকে। সম্প্রতি কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, অবৈধ লেনদেনের ব্যাপারে যেভাবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে তাতে উপচার্য সর্বোচ্চ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বলে মেনে নেওয়া যায় না। উন্নয়নের টাকা যেভাবে সিন্ডিকেট সদস্যরা ভাগাভাগি করেন এবং ছাত্রনেতা যেখানে জড়িত থাকেন, তা এখন আর অতীতের কোনো ঘটনা নয়। আমার মনে আছে, রাজনৈতিক মামলায় আমার পুত্র যখন কারাগারে বন্দি, তখন একজন এডভোকেট যাকে আমি চিনি না, তিনি এসে বললেন, সব রাজনৈতিক নেতা এন্টিসেপ্টারি বেল পেয়েছেন। পাঁচ লাখ টাকা খরচ করলে আপনার ছেলে কালই জামিন পেয়ে যাবেন। আমি বলেছিলাম যে, পাঁচ বছর কারাগারে থাকলেও আমি ঘুষ দিয়ে জামিন নেব না। আমার বিশেষ পরিচিত একজন সেশন জজ একবার কয়েকটা কাঁঠাল নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসলেন। তদবির হলো হাইকোর্টের জজ হওয়ার। আমি বললাম, আমি তদবির করি না। পরে দেখলাম দুবছর পরে স্ফীত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। কোনো দেশে শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থায় যদি দুর্নীতির কারণে প্রভাবান্বিত হয়, তাহলে সে দেশের ভবিষ্যত কি!

যে কথাগুলো উত্থাপন করলাম, তাতে কোনো বিশেষ একটা দল বা নেতা করেছেন তা নয়। তবে বাস্তবতাটা হচ্ছে, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের এই ক্রিয়াকলাপ করার সুযোগ বেশি থাকে। কিছুদিন আগে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ১০ লাখ করে টাকা নিয়ে লেকচারার নিয়োগ দেন। পরে অবশ্য তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুরু করেছেন, তার সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছেন। এই অভিযান শিক্ষাঙ্গন ও বিচারালয়ে সর্বপ্রথম চালানো উচিত। কি দেখলাম আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়, আরও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করার সুবাদে আমাকে যেসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে- তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপাচার্য ও সিন্ডিকেট কর্তৃক সৃষ্ট দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ডের জন্য। সবাই জানে স্থানীয়ভাবে শিক্ষক, ছাত্র ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কারা দুর্নীতি করেন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসের পর মাস বিশৃঙ্খলা চলছে। কিন্তু কেউই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এগিয়ে আসছেন না। কেউ কেউ উপাচার্যের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন অথবা সংশ্লিষ্ট না হওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। শুনলে অবাক হবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন প্রক্রিয়ায় যে ধরনের দলাদলি সংঘাত এমনকি সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে, তা কল্পনাতীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, এখন অন্তত ৪টাতে প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। ধরে নেওয়া যায় তারা উচ্চমানের বুদ্ধিজীবী, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই মিলেই সম্মিলিতভাবে একটা কমিটি গঠন করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরক্ত হন। নিজেরাই কোন্দল সৃষ্টি করে ঢাকায় আসেন সমাধানের পথ খুঁজতে।

আমরা বারবার কেন্দ্র থেকে বলে আসছি প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু এই নীতি কার্যকর করা যাচ্ছে না। ওরা আর আমরা এই বিভেদ নীতি কার্যকর রয়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখি মূল দ্বন্দ্বের কারণ স্বার্থজনিত ভাগবাটোয়ারা। এটা একান্তই দুঃখজনক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার বা কোষাধ্যক্ষ কি করে ২য়বার এমনকি ৩য়বার নিয়োগ পান, তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই এই দায়িত্ব নিতেই হবে। একজন দুর্নীতিবাজ উপাচার্য কি করে পুনরায় নিয়োগ পান সেই রহস্য উদ্ঘাটন করে ওই প্রক্রিয়া চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের সম্মানজনকভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। ছাত্র সংগঠনসমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।

সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ড ও অসহনীয় আচরণ ঘটছে, তা সত্য-সত্যই কলঙ্কজনক। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, তবে এখনো শিক্ষার মান বাড়েনি। গবেষণামূলক কর্মকান্ডে স্থবিরতা এসেছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডকে এখন কী বলে অভিহিত করা হবে তা বলা দুষ্কর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণামূলক, সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের সুফল জাতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোগ করছে না। একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থানে আছে। উদ্ভাবন প্রক্রিয়া অগ্রসরমান রয়েছে।

শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিশেষ নজরের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু অর্থ বরাদ্দ করলেই হবে না। সে অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। শিক্ষার প্রকৃতিগত যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা আরও উন্নততর হওয়া দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শান্তি, শৃঙ্খলা, সততা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। সরকার প্রধান অত্যন্ত সৎ ও সৃষ্টিধর্মী প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তার প্রতিফলন কর্মক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখা যাচ্ছে না। আসুন আমরা সবাই মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিচারালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে সাহায্য করি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানকে সফল করি।

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<87893 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1