আরেক দফা বিদু্যতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই মূল্য বাড়ার কথা থাকলেও এ মাসেই বিদু্যতের নতুন মূল্য ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছে কমিশন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদু্যতের মূল্যবৃদ্ধিতে দুর্ভোগে পড়বে দেশের জনগণ। এর ফলে আরেক দফা দ্রব্যমূল্য বাড়বে। বাড়বে পরিবহন ভাড়া। বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্পক্ষেত্রে ও বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনীতিতেও। বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এটিও নিশ্চিত। এর ফলে উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন। বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই পড়ে, এটা সংশ্লিষ্টরা অবগত থাকা সত্ত্বেও এ মাস থেকেই বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বর্তমানে চাল-ডাল-ভোজ্যতেল-পেঁয়াজ-রসুন ও অন্যবিধ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন এমনিতেই আতঙ্কে। এ অবস্থায় বিদু্যতের আবারও মূল্যবৃদ্ধি গ্রাহকের জন্য হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের শামিল। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারের উৎপাদকের পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। বারবার বিদু্যতের দাম বাড়ানো নাগরিকদের জীবনযাত্রায় বাড়তি চাপ যোগ করবে- এটাই স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতি কাম্য নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, সংশ্লিষ্টরা মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরকারের ভর্তুকির বিষয়টি সামনে আসে। এমনও দেখা গেছে গণশুনানিতে মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পরও সংশ্লিষ্টরা বিদু্যতের মূল্য বাড়িয়েছেন। তথ্য মতে, উৎপাদন এবং বিপণন প্রক্রিয়ায় সমন্বয় না থাকায় 'সিস্টেম লস' হওয়া এবং এ খাতের দুর্নীতির বিষয়টিও সবারই জানা। সংশ্লিষ্টরা সেদিকে নজর না দিয়ে মূল্য বৃদ্ধিকেই সহজ সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নেন। যার খেসারত দিতে হয় জনগণকে। এ পরিস্থিতি একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য হতে পারে না। জানা যায়, বেসরকারি বিদু্যৎকেন্দ্রগুলো অলস বসে থাকলেও কেন্দ্র ভাড়া ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। তেল দিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন করলে ব্যয় বেশি বলে বিদু্যৎকেন্দ্রগুলো বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখা হয়। সবকিছু মিলিয়ে বিদু্যৎ বিভাগের লোকসানের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এই লোকসান সামাল দিতে গিয়ে সরকার বারবার গ্যাস-বিদু্যতের দাম বাড়ানো বিকল্প হিসেবে বেছে নেবে তা গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, গত ১০ বছরে খুচরা বা গ্রাহকপর্যায়ে বিদু্যতের দাম বেড়েছে ছয়বার। আর পাইকারি পর্যায়ে বেড়েছে চারবার। এর মধ্যে ২০১৭ সালে এক বছরের মধ্যে দুবার বিদু্যতের দাম বাড়ানো হলে কনজিমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) উচ্চ আদালতে একটি রিট করে। আদালত বিইআরসির কাছে জানতে চান, বছরে দুবার দাম বাড়ানোর কথা আইনের কোথায় আছে। বিইআরসি তখন এর ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে সম্প্রতি মন্ত্রিসভা জ্বালানির দাম বছরে একাধিকবার পরিবর্তন করা যাবে, এমন বিধান রেখে বিইআরসি (সংশোধন) আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। মূলত জনগণের কথা না ভেবে সরকার এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অস্বীকারের সুযোগ নেই, বাংলাদেশে একবার কোনো জিনিসের মূল্য বাড়লে তা আর কমে না। এমনকি বিশ্ববাজার সংশ্লিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে দাম কমলেও দেশে কমানো হয় না। আর এ প্রক্রিয়ায় সবসময়ই জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। জানা যায়, বিশ্ববাজারে অনেক দিন থেকেই জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী। দেশীয় বাজারেও ফার্নেস অয়েলের দাম কমানো হয়েছে। এতে বিদু্যৎ উৎপাদনের খরচ কমে গেছে। দেশে গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি বিদু্যৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিদু্যতের দাম কমার কথা। কিন্তু দাম না কমিয়ে উল্টো বিদু্যতের মূল্য বাড়ানোর উদ্যোগ কেন নেয়া হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
সর্বোপরি বলতে চাই, বিদু্যতের দাম বাড়লে সব রকম দ্রব্যমূল্য ও সেবামূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর শেষ পর্যন্ত তা বহন করতে হয় ভোক্তা সাধারণকে। তাই সাধারণ ভোক্তাদের সামর্থ্য তথা জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিদু্যতের দাম কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় তা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার বিদু্যতের মতো জরুরি প্রয়োজনীয় সেবা খাতের ব্যাপারে জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করবে এটাই প্রত্যাশিত।