শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিপস্নবী জননেতা বাদশাভাই স্মরণে রণেশ মৈত্র

বাদশাভাই ভাষা আন্দোলনসহ এ দেশের সব স্বাধিকার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে, আমৃতু্য বয়ে বেড়িয়েছেন পুলিশের বুলেট। তবে, তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আমি দাবি জানাব, বাদশাভাইসহ পাবনার সব ভাষাসংগ্রামীদের বাড়ির সামনের রাস্তা তাদের নামে করা হোক। জেলা পরিষদ, পৌরসভা খুব সহজেই কাজটি করতে পারে। সরকারের কাছে আবেদন, মুক্তিযোদ্ধার মতো ভাষাসংগ্রামীদের তালিকাও অবিলম্বে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হোক। মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে শহিদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পাশাপাশি বাঙালি পুনর্জাগরণ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হোক।
নতুনধারা
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

৫ ফেব্রম্নয়ারি ২০২০ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলাদেশ সরকার ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে প্রয়াত জননেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। মরণোত্তর। বাংলাদেশ সরকারকে এ কারণে অভিনন্দন জানাই। যদিও বাদশাভাইয়ের একুশে পদকপ্রাপ্তি অনেক আগেই কাম্য ছিল।

আমার বাল্যকাল থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন আমার অন্যতম সহকর্মী-সহযোদ্ধা। এই আনন্দক্ষণে তিনি জীবিত না থাকায় তার সহধর্মিণী, আমাদের প্রিয় ভাবীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।

বাদশাভাই আমার চেয়ে বয়সে বড়। তার জন্ম তারিখ ১৪ এপ্রিল, ১৯২৯। আমার জন্ম তারিখ ৪ অক্টোবর ১৯৩৩। রাজনীতিতেও তিনি আমার সিনিয়র। তার জন্ম পাবনা শহরে, আমার জন্ম গ্রামে। পাবনা শহরে স্থায়ীভাবে চলে আসি ১৯৪৭ সালে। ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণিতে তৎকালীন খ্যাতনামা গোপাল চন্দ্র ইনস্টিউশনে। তখনও বাদশাভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।

পরিচয় ঠিকই হলো, পাবনা শহরের রাজপথে। ১৯৪৮ সালের মার্চেও এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে। রাজপথে ভাষা আন্দোলনের বিশাল মিছিলে। আসলে সেটা পরিচয় না বলে প্রথম সাক্ষাৎ বলাই শ্রেয় হবে। মিছিলে আসার উৎসাহ দেখে নাম ও কোন স্কুলের ছাত্র জানতে চাইলেন। বললাম। শুনে বললেন আমি তো ওই স্কুলেরই ছাত্র। ঠিক আছে বিকােল ছাত্র ফেডারেশন অফিসে এসো, কথা হবে।

দিনকয়েক পরে এক সন্ধ্যায় গেলাম খেয়াঘাট রোডের ভাঙাচোরা টিনের ঘরে যেখানে ছাত্র ফেডারেশনের কার্যক্রম চলত। বাদশাভাই বললেন, সদস্য হতে। আমি বললাম ভেবে দেখি। এরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। ছাড়া পান ১৯৫০ সালে। মুক্তির পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করতে শুরু করেন। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি। দিনের পর দিন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কখনো বাসায়, কখনো ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে, কখনো বা রাজপথে। ইতিমধ্যেই আমরা কে সিনিয়ার কে জুনিয়র ভুলে সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। কারাগারের ভেতরেও তাই। যখনই পুলিশ গ্রেপ্তার করত, আটকাবস্থায় থানায় গিয়ে দেখতাম, বাদশাভাই, প্রসাদ দা দিব্যি সেখানে বসে আছেন যেন আমারই অপেক্ষায়। এমনটাই চলতো ষাটের দশকের শেষ অবধি।

ন্যাপ গঠিত হলো ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে। বাদশাভাই পার্টির নির্দেশে ১৯৫৮ সালে ন্যাপে যোগ দিলেন। পরে ন্যাপের বারবার অপ্রত্যাশিত ভাঙনে আলতাফ হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন।

বাদশাভাইকে বিয়ের রাতেও পুলিশ তাকে রেহাই দেয়নি। বাসর ঘরে নববধূকে একলা রেখে তার বিয়ের রাত কাটল গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। তারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। কারণ পুলিশের ধারণা ছিল তিনি বিয়ে করছেন না। রাজনৈতিক কৌশলে বিয়ের নাটক সাজিয়ে গ্রেপ্তার এড়াচ্ছেন। অবশ্য তাদের এ ধারণা ছিল পুরোপুরি ভ্রমাত্মক।

বাদশাভাই দুই শ্যালিকার বিয়ে দেন দুজন ন্যাপ নেতার সঙ্গে। তার একজন সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম, অন্যজন ঈশ্বরদীর আব্দুল হালিম চৌধুরী। তারা তিনজনই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনজনই পরে গণতন্ত্রী পার্টি গঠনে ভূমিকা পালন করেন। হালিম চৌধুরী আজও জীবিত, কিন্তু রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নন।

আমিনুল ইসলাম বাদশা সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন একেবারেই স্বেচ্ছায়। দেশে যখন প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তিনি তখন শহরের বাসনপট্টিতে ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া নিয়ে সমৃদ্ধ একটি বইয়ের দোকান খুললেন। দোকানে রাখতেন মার্কসীয় রাজনীতির বই, প্রগতিশীল লেখক-লেখিকাদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এসব গ্রন্থ। মার্কসবাদে যেসব যুবক-যুবতী আকৃষ্ট হতেন, তাদের জন্য প্রাথমিক রাজনীতি, অর্থনীতি শিক্ষার বই মজুদ রাখতেন। যাদের বই কিনে পড়ার সাধ্য ছিল না তাদের দোকানে দাঁড়িয়ে বা বসে বই পড়ার সুযোগ দিতে কার্পণ্য করতেন না।

সাদাসিধে পোশাকের মানুষটিকে কখনো রিকশায় চড়তে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দূরে যেতে হলে বাসে যেতেন, শহরে সর্বত্র হেঁটেই চলাফেরা করতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, হেঁটে চলাফেরা মূলত দুটি কারণে-

এক, ডায়াবেটিক রোগীর উপকার হয়। দুই, পরিচিতজনের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়।

আসলেই পরিচিত কাউকে পেলে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে যেতেন বাদশাভাই। অবস্থা এমন হয়েছিল দূর থেকে তাকে দেখলে অনেকে অন্য রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে যেতেন, তাকে এড়ানোর জন্য। কারণ সবার হাতে তো অত সময় থাকত না।

বাদশাভাই ভাষা আন্দোলনসহ এ দেশের সব স্বাধিকার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে, আমৃতু্য বয়ে বেড়িয়েছেন পুলিশের বুলেট। তবে, তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আমি দাবি জানাব, বাদশাভাইসহ পাবনার সব ভাষাসংগ্রামীদের বাড়ির সামনের রাস্তা তাদের নামে করা হোক। জেলা পরিষদ, পৌরসভা খুব সহজেই কাজটি করতে পারে। সরকারের কাছে আবেদন, মুক্তিযোদ্ধার মতো ভাষাসংগ্রামীদের তালিকাও অবিলম্বে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হোক। মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে শহিদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পাশাপাশি বাঙালি পুনর্জাগরণ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হোক। সব ভাষাসংগ্রামীকে একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

আমিনুল ইসলাম বাদশা ১৯৪৮-এর ভাষাসংগ্রামে যে বিশাল অবদান রেখেছেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমরা পাবনাবাসী তা ভুলতে বসেছি।

এই শুভলগ্নে তার বিদেহী আত্মাকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাই।

রণেশ মৈত্র: সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

ৎধহবংযসধরঃৎধ@মসধরষ.পড়স.

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88406 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1