মাইক্রোপস্নাস্টিক: পরিবেশ, মানবজীবন ও পশুপাখির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ

প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

তামান্না ফেরদৌস শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
মানবসভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পরিবেশ। পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও জীবনের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। নানা কারণে পরিবেশ দূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা বর্তমান বিশ্বে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে থাকে যার মধ্যে পস্নাস্টিক দূষণ অন্যতম। তাই পস্নাস্টিক দূষণ রোধ করতে সারাবিশ্বে নেওয়া হচ্ছে কার্যকর পদক্ষেপ। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এসবের মধ্যেও যে বিষয়টি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে তা হলো মাইক্রোপস্নাস্টিক। মাইক্রোপস্নাস্টিক হচ্ছে পস্নাস্টিকের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ। যে সব পস্নাস্টিকের আকার ২ মাইক্রোমিটার থেকে ৫ মিলিমিটারের মধ্যে, সেসব পস্নাস্টিককে মাইক্রোপস্নাস্টিক বলা হয়। মাইক্রোপস্নাস্টিক সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। নিত্যব্যবহার্য পস্নাস্টিক বর্জ্য, কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে মিশে থাকা পস্নাস্টিক প্রতিনিয়ত পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাপমাত্রা, ক্ষুদ্র অণুজীব এবং নানা কারণে এসব পস্নাস্টিক ভেঙে যায় এবং পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র পস্নাস্টিকে বা মাইক্রোপস্নাস্টিকে। ২০১৪ সালের প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে সামুদ্রিক পস্নাস্টিক বর্জ্য দূষণ শীর্ষ দশ জরুরি পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং মাইক্রোপস্নাস্টিকের ওপর বিশেষ মনোযোগ প্রদান করা হয়। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে, মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণ পরিবেশ এবং পরিবেশ বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ও ওজোন হ্রাসের পাশাপাশি মাইক্রোপস্নাস্টিক একটি বড় বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যা হয়ে ওঠে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব মাইক্রোপস্নাস্টিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানে যেমন মাটি, পানি, বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যাচ্ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে এসব মাইক্রোপস্নাস্টিক পুকুর, নদী এবং সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। সামুদ্রিক মাছসহ স্বাদুপানির মাছ এদের খাবার হিসেবে গ্রহণ করছে। ফলে এরা সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। খাদ্যশৃঙ্খলের প্রথম স্তরের খাদককে দ্বিতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে, দ্বিতীয় স্তরের খাদককে তৃতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে, তৃতীয় স্তরের খাদককে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক ভক্ষণ করে। এভাবে খাদ্যশৃঙ্খলের পর্যায়ক্রমিক পরিক্রমায় মাইক্রোপস্নাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করছে যা শুধু মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারকই নয় বরং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রজাতির ওপর মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণ শীর্ষক এক চলমান যৌথ গবেষণায় জানা যায়, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অণুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের পস্নাস্টিক বা মাইক্রোপস্নাস্টিক পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে এবং চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান থেকেও পস্নাস্টিক বর্জ্য এসে পড়ছে আমাদের বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদ বলেন আমরা যেখানেই পস্নাস্টিকের দূষণ করি না কেন তা সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। সমুদ্রে পস্নাস্টিক দূষণের পর তা পানির তোড়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙে। ভাঙা অংশগুলো পুনরায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভেঙে ন্যানো, মাইক্রো এবং ম্যাক্রোপস্নাস্টিকে পরিণত হয়। এই ভাঙনের ফলে সৃষ্ট পস্নাস্টিকের কিছু উপাদান (ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য যেমন বিসফিনলে নির্গত হয়) মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব মাইক্রোপস্নাস্টিক সামুদ্রিক মাছসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। সুতরাং এসব মাইক্রোপস্নাস্টিক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী বলেন, কক্সবাজারের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় বাঁকখালী নদীর মোহনা ও সোনাদিয়ার পাশে সমুদ্রের উপরিভাগের পানি থেকে মাইক্রোপস্নাস্টিক সেম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে, লাবণী পয়েন্ট সৈকতের ও কাঁকড়া বিচের বালিতে পস্নাস্টিকের দূষণ নির্ণয় করা হয়েছে এবং অপরিশোধিত ও পরিশোধিত (বাণিজ্যিক) লবণে মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণ পরীক্ষা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গবেষক দলের প্রধান ড. হারুনুর রশীদ আরও বলেন, বাঁকখালী নদীর মোহনায় পানির উপরিভাগে ভাসমান অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২০ হাজারেরও বেশি মাইক্রোপস্নাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া মহেশখালী, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে সংগৃহীত অপরিশোধিত লবণে কেজিতে প্রায় ১০০০টি এবং পরিশোধিত লবণে প্রতি কেজিতে পাওয়া গেছে ৭০০ থেকে ৯০০টি মাইক্রোপস্নাস্টিক। মাটিতে মিশ্রিত পস্নাস্টিক বিভিন্ন ধরনের অণুজীব যেমন- সিউডোমোনাস, নাইলন খাদক ব্যাকটেরিয়া, ফ্লাভো ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ভেঙে মাইক্রোপস্নাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। জীবাণুবিয়োজ্য পস্নাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে যা এক প্রকার গ্রিন হাউস গ্যাস। এ ছাড়া ক্লোরিনযুক্ত পস্নাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। যেহেতু পস্নাস্টিক মাটিতে পচতে সময় লাগে প্রায় ৪০০ বছর সুতরাং এটি একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে অন্যদিকে এটি ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অতঃপর এসব পানি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তা আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে এবং আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। লন্ডনের কিংস কলেজের এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ গ্রম্নপের অধ্যাপক ফ্র্যাংক কেলির দাবি বাতাসেও মিশে গেছে মাইক্রোপস্নাস্টিক। কিন্তু বাতাসে এর ঘনত্ব নির্ণয় করা হয়নি। বাতাসে মাইক্রোপস্নাস্টিকের অন্যতম একটি উৎস সম্ভবত ফসলি জমিতে ব্যবহৃত সার। এসব সার শুকিয়ে গেলে তাতে থাকা মাইক্রোপস্নাস্টিক বাতাসে মিশে যায় বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। এমনকি সিনথেটিক কার্পেট ও কাপড় থেকেও মাইক্রোপস্নাস্টিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের নিত্যব্যবহার্য কসমেটিক্স পণ্য, পরিষ্কারক পণ্য যেমন ডিটার্জেন্ট, ফেসওয়াশ, স্ক্র্যাব, ক্রিম ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মাইক্রোবেড তথা মাইক্রোপস্নাস্টিক। এমনকি টুথপেস্টেও ব্যবহার করা হচ্ছে মাইক্রোবেড। দেশে উৎপাদিত এবং বাইরে থেকে আমদানিকৃত এসব পণ্যে মাইক্রো পস্নাস্টিক বিদ্যমান যা দেশের বাজার বা মার্কেটগুলোতে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। এসব মাইক্রোপস্নাস্টিক কোনো পস্নাস্টিক থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরিকৃত মাইক্রোপস্নাস্টিক নয় বরং ইঞ্জিনিয়ারিং উপায়ে তৈরিকৃত মাইক্রো পস্নাস্টিক যা এসব পণ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে অন্যদিকে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এসব কসমেটিক্স পণ্য ব্যবহারের পর তা পানির সঙ্গে মিশে ভেসে যাচ্ছে খাল, নদী কিংবা সমুদ্রে। বর্তমানে অনেক বোতলজাত পানিতেও পাওয়া গিয়েছে মাইক্রোপস্নাস্টিক। এ ছাড়া টি-ব্যাগ থেকে তৈরিকৃত চায়ে মিশে যেতে পারে মাইক্রোপস্নাস্টিক। সাধারণত টি-ব্যাগ প্রাকৃতিক ফাইবার দ্বারা তৈরি হলেও তা এঁটে দিতে ব্যবহার করা হয় পস্নাস্টিক। উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে এসব থেকে মাইক্রোপস্নাস্টিক চায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। প্রায় ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটন্ত পানিতে ১১.৬ বিলিয়ন ন্যানোপস্নাস্টিক তথা সেকেন্ডারি মাইক্রোপস্নাস্টিকের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন কানাডার ম্যাক গিল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। এ ছাড়া কাপড়ে ব্যবহৃত সিনথেটিক ফাইবার যেমন পলিইস্টার, নাইলন ইত্যাদি থেকেও মাইক্রোপস্নাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মাইক্রো পস্নাস্টিক যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষসহ অন্যান্য পশুপাখির ওপর। এর ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যতা। ক্যান্সার, হরমোনের তারতম্য, প্রজনন প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া ছাড়াও মারাত্মক সব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইক্রোপস্নাস্টিক। বাংলাদেশে মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণ একেবারেই নতুন একটি বিষয় এবং নির্মাতা ও ভোক্তা কেউই মাইক্রোপস্নাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয়। আর তাই মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে এক ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে চলছে। অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পস্নাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক অনেক কম। এ ছাড়া বলা হয়ে থাকে যে নদী-নালা-খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ। ফলে পানির অবিরাম প্রবাহ দেশের অধিকাংশ পস্নাস্টিক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের একমাত্র সাগর বঙ্গোপসাগরে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট পস্ন্যান্ট পেরিয়েও সহজে চলে যাচ্ছে এসব মাইক্রোপস্নাস্টিক। মাইক্রোপস্নাস্টিক দূষণের ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এ ছাড়া অতীতে উৎপাদিত পস্নাস্টিক বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জোর দিতে হবে পস্নাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, রিসাইক্লিংয়ের ওপর। পস্নাস্টিকের বিকল্প হিসেবে জৈবিক পস্নাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তা ছাড়া মাইক্রোপস্নাস্টিকের ওপর সরকারিভাবে, বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কাজ বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি মাইক্রোপস্নাস্টিক এবং এর ভয়াবহ দিক সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।