হ্যালো লিডার হ্যালো মিনিস্টার

দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশ এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তে বাধা কোথায়?

প্রাথমিকভাবে অন্তত ১০ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকা তৈরি করে তাদের ছবি, জীবনবৃত্তান্ত ও অপকর্মের বিস্তারিত মিডিয়া ও সবাদপত্রে প্রকাশ করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার ও ব্যানার করে তাদের সম্পর্কে জনগণকে জানানো যেতে পারে। এসব দুর্নীতিবাজের সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ ও সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করাও একটি জোরালো পদক্ষেপ হতে পারে। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হলে একটি বড় সতর্কবার্তা যাবে সব দুর্নীতিবাজের কাছে।

প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সোহেল হায়দার চৌধুরী
দুর্নীতি নিয়ে দেশব্যাপী কমবেশি আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে হলেও নানাভাবে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে ক্ষতবিক্ষত হয় তারা। দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে কার্যকরী পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয় কখনোই। দুর্নীতি বন্ধ-নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলে দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন থাকলেও তারা যে বড় ধরনের কোনো বিপস্নব করতে পেরেছে সেটাও খুব জোর দিয়ে বলা যাবে না। দুর্নীতি বন্ধে সরকার বা রাষ্ট্রের কমিটমেন্টও যে খুব শক্তিশালী তাও বলার জো নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী সরকারগুলো কালেভদ্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে জনগণকে 'বোকা' বানানোর চেষ্টা করেছেন এবং নিজেরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বা সামাজিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দুর্নীতি বন্ধে এখন প্রায়ই কথা হয়। কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে সব কথা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম এ ক্ষেত্রে অবলীলায় বলা যায়। এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছেন। তার এ ঘোষণার পরে দুর্নীতিচক্রের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়ালেও এখন পর্যন্ত ফলাফল খুব আশাব্যঞ্জক নয়। এর মূল কারণ হলো যারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন তারা এখনো তাদের দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করছেন না। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তর আজ দুর্নীতির বিষক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত। দেশে সৎ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রাধান্য বেশি। যারা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করেন বা করতে চান, তারা নানাভাবে দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীর ব্যক্তির কাছে পরাস্ত হন। একজন দুর্নীতিবাজ বিত্তশালী ব্যক্তি সমাজ বা রাষ্ট্রে যেভাবে দম্ভের সঙ্গে বিচরণ করছেন একজন সৎ মানুষ তা পারছেন না। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে হস্তগত করার জন্য বা সম্পদ দখলের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো দুর্নীতিবাজ বড় ধরনের সঙ্কটে পড়েননি। আর এর পেছনে রাষ্ট্রে গড়ে ওঠা অনিয়মের নিয়ম সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। দুর্নীতি বা অনিয়ম করেও একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি যেভাবে পান, অন্যদিকে একজন সৎ মানুষ তা থেকে বঞ্চিত হন। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-সামাজিক অবস্থানে দুর্নীতিবাজ বা অনিয়মকারী ব্যক্তিটির বৃত্ত থেকে বের হতে পারছেন না সৎ মানুষটি। সততার পুরস্কার পাচ্ছেন না তিনি রাষ্ট্র বা সমাজের কাছ থেকে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র বা সমাজে দুর্নীতির যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা সহজে মোচন করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে এখন বিস্তারিত পর্যালোচনার সময় এসেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশিত 'শুদ্ধি অভিযান' সফল করতে হলে সৎ এবং অসৎ ব্যক্তির সুস্পষ্ট রেখা তৈরি করতে হবে। সততা এবং অসততার পরিমাপক নির্ধারণ করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। সেই পরিমাপকের সূত্র ধরে অসৎ ব্যক্তিকে যেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, তেমনি সৎ মানুষটিকে পুরস্কৃত করতে হবে। বাংলাদেশে মূলত রাজনীতি এবং প্রশাসনের হাত ধরে দুর্নীতি বিস্তৃত হয়েছে। একসময় রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বা দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতায়ন করেছেন নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নতুন সংগ্রাম শুরু করেছেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজ চক্র আজও কোটি মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের যে কটি লক্ষ্য ছিল তার অন্যতম হলো রাষ্ট্র এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। সে জায়গাটিতে আমরা এখনো যেতেই পারিনি। উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরু করে আমরা এগিয়ে চলেছি ঠিকই, কিন্তু সাম্যের বাংলাদেশ তৈরির পথে এখনো জোর কদমে চলতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখনই ভাবা দরকার। দুর্নীতি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হলে শুধু মুখের কথায় বা কিছু ব্যক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অথবা দু'চরজনকে শাস্তি দিয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন গুচ্ছ পরিকল্পনা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতিবিরোধী জোর প্রচারণা। দেশে মূলত দুই ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে। এর একটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক অন্যটি ব্যক্তিগত দুর্নীতি। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি 'জায়েজ' হয়ে যাওয়ায় ব্যক্তিগত দুর্নীতির ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে। আর সব ক্ষেত্রেই কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন পদ্ধতির ফাঁক তৈরি করে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দুর্নীতির পথ তৈরি করে দেন। সে পথ ধরে বছরের পর বছর চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক নামিদামি ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব। তারা নানা কৌশলে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়েন আর রাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। এরা এতই ক্ষমতাবান যে রাষ্ট্রের বা আইনের হাত এদের অনেকের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। সে জায়গায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন লড়াইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। এ লড়াইয়ে তিনি জয়ী হলে শুধু বঙ্গভূমি নয়, পুরো বিশ্ব আবারও নতুন করে চিনবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে। সে জন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে সামনের দিকে। জনগণ মনে করে এখন থেকে প্রতি বছর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ হওয়া দরকার। কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশকে সাধুবাদ জানিয়েছে জনগণ। এবার দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশ করা হোক। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে অন্তত ১০ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকা তৈরি করে তাদের ছবি, জীবনবৃত্তান্ত ও অপকর্মের বিস্তারিত মিডিয়া ও সবাদপত্রে প্রকাশ করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার ও ব্যানার করে তাদের সম্পর্কে জনগণকে জানানো যেতে পারে। এসব দুর্নীতিবাজের সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ ও সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করাও একটি জোরালো পদক্ষেপ হতে পারে। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হলে একটি বড় সতর্কবার্তা যাবে সব দুর্নীতিবাজের কাছে। যারা কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার ধ্বংস করল, যারা ব্যাংকিং সেক্টরকে লুটেপুটে খেয়ে ধ্বংস করে দিল, যারা প্রশাসনে বদলিবাণিজ্য করে শত শত কোটি টাকা কামাই করল অথবা যারা রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অবৈধ পথে অর্থ-সম্পদ গড়ল, যারা রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে খাল দখল করল, মানুষের আশ্রয় পুড়িয়ে দিয়ে বা ছাত্রনিবাস দখল করে মার্কেট গড়ে তুলল, সংসদ সদস্য তকমা ব্যবহার করে দখলবাজিতে মত্ত, সড়ক ও নৌ পরিবহণ থেকে কোটি কোটি টাকা অবৈধ চাঁদা তুলছে, খাদ্য মজুতদারি করে মানুষের পকেট কাটছে- তাদের সবার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। এই শাস্তি শুধু 'সৌজন্য শাস্তি' হলে চলবে না। প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। বাংলাদেশে যে অনিয়মের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিছু অসাধু প্রভাবশালী চক্র সেটিকে পুনর্নিয়মের বৃত্তে বাঁধতে হলে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তাতে তার নাম ব্যবহার করে বা রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব দেখিয়ে আর কেউ অন্তত দুর্নীতি-অনিয়ম-অপকর্ম করতে পারবে না এটা জনগণ বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসের ভিতকে মজবুত করতে হলে প্রয়োজন সব দুর্বলতা ও সরলতার ঊর্ধ্বে উঠে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেটি পারেন এমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় 'শুদ্ধি অভিযানের' পূর্বাপর বিশ্লেষণে। এখন তার পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দেখতে চায় দেশের জনগণ। জনগণ চায়, সমাজের সব স্তরে ধাপে ধাপে শুদ্ধি অভিযান চালানো হোক। অশুদ্ধতার বৃত্ত ভেঙে শুদ্ধতার নতুন আলো জ্বালিয়ে শেখ হাসিনা এই দেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাবেন তেমন প্রত্যাশা সাধারণের। শ্রেণিবৈষম্যহীন এক রাষ্ট্রের প্রত্যাশায় থাকা জনগণ মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে শুদ্ধতার বিশুদ্ধ রাগ ছড়িয়ে দিতে পারেন শেখ হাসিনা। জনগণ মনে করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে নানা বৈপস্নবিক পরিবর্তন এনেছে। এবার সর্বাঙ্গীনভাবে শুদ্ধসমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন তিনি। সেজন্য জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। থাকতে হবে ধারাবাহিক জবাবদিহি ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রথী-মহারথী বা সাধারণের পার্থক্য বিলোপ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সৎ মানুষের খোঁজে এগিয়ে যেতে হবে রাষ্ট্রকে। সৎ মানুষের পুরস্কার এবং গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি অসৎ ব্যক্তিদের মুখোশ ধারাবাহিকভাবে উন্মোচন করা হলে দেশবাসী আস্থাশীল হবে সরকারের প্রতি। সোহেল হায়দার চৌধুরী: বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)