সঞ্চয় ও আর্থিকব্যবস্থা

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অবস্থা খুবই নাজুক। পুঁজিবাজারের ধসের কারণে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন যদি মুদ্রাবাজারের অবস্থা সেরকম হয় তাহলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা কোনপর্যায়ে যাবে তা ভাবাই যায় না। তাই আর্থিক স্থবিরতার হাত থেকে সমষ্টিক অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে ব্যাস্টিক আর্থিকবাজার ব্যাংকব্যবস্থায় সঞ্চয়ের সুদের হার কমানো ঠিক হবে না।

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সম্প্রতি সরকার দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য একটি নতুন আইন করতে যাচ্ছেন। এই নতুন আইনে সরকার আমানতকারীর স্বার্থ দেখছেন না। আইনটির সার সংক্ষেপ হলো, ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় রাখার বিষয়ে। কোনো কারণে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে, আমানতকারী তার জমাকৃত অর্থের বিপরীতে এক লাখ টাকার বেশি ক্ষতিপূরণ পাবেন না। যদি তার জমাকৃত অর্থ এক কোটিও হয় তাকে দেয়া হবে মাত্র এক লাখ টাকা এর বেশি ক্ষতিপূরণ তিনি দাবি করতে পারবেন না। অন্যদিকে এক লাখের নিচে জমাকৃত অর্থে সেই পরিমাণেই ক্ষতিপূরণ পাবেন। বিষয়টি যদি আইনে পরিণত করা হয়, তাহলে ব্যাংকে সঞ্চয় জমা রাখার প্রবণতাটা কমে যাবে। কারণ দেশে বেসরকারিভাবে বহু ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত অনেক বেসরকারি ব্যাংকের দেউলিয়াত্বের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এই ব্যাংকটি বর্তমানে ইসলামিক ব্যাংকের সহযোগিতায় এখন চলছে। এরকম বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দেউলিয়া বা বন্ধ হওয়ার পথে, তবে বন্ধ হয়ে যায়নি তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এখনো চলছে। সাধারণ আমানতকারীরা বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় জমার বিষয়ে এই আইনের কারণে চরম আস্থাহীনতায় পড়ছেন। এই আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকে আমানতকারীর সংখ্যা কমে গেলে ব্যাংকগুলির ঋণ প্রদানের পরিমাণটাও কমে যাবে এই কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়বে। ফলে দেশের স্বল্পমেয়াদি অর্থবাজার মুদ্রাবাজারে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। যেমন নেতিবাচক ধারায় চলছে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থবাজার পুঁজিবাজার। অন্যদিকে বিভিন্ন সঞ্চয় আমানতের ওপর সরকার সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ঘোষিত বিভিন্ন সঞ্চয়ের সুদের হার আগের চেয়ে অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে। দেশের স্বল্পমেয়াদি অর্থ বাজারব্যবস্থায় নধহশ রং রহঃবৎসরফরধঃড়ৎু রহংঃরঃঁঃব। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের সঞ্চয় নিয়ে তা আবার ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে। মূলত ব্যাংকগুলোকে এক অর্থে বলা যায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। নতুন আইনের কারণে সঞ্চয় জমার পরিমাণ কমে গেলে ব্যাংকগুলোর ঋণপ্রদানের সক্ষমতা কমবে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের বিনিয়োগটাও কমে যাবে। বিনিয়োগ কমে গেলে বাড়বে বেকারত্ব। আর বেকারত্ব বাড়ার কারণে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেওয়াটাই হবে স্বাভাবিক। কোনো দেশের স্বল্পমেয়াদি অর্থবাজার বা মুদ্রাবাজার হলো দেশের আর্থিক লেনদেন পরিচালনার জন্য যেসব ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে অর্থের লেনদেন পরিচালনা করে তাদের সমষ্টিকে মুদ্রাবাজার বলা হয়। অর্থনীতিবিদ ক্রাউথারের মতে, বিভিন্ন ফার্ম বা প্রতিষ্ঠান যারা প্রতিদিন মুদ্রা নিয়ে লেনদেন করে তাদের এই ব্যবস্থাটাই হলো মুদ্রাবাজার। মুদ্রাবাজার সাধারণত স্বল্প সময়ের এবং এই বাজারে প্রচলিত বন্ড বা চেকগুলো দ্রম্নত বিনিময়যোগ্য। প্রতিটি দেশের মুদ্রাবাজার হলো সেই দেশের অর্থনৈতিকব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বাজারের অন্তর্ভুক্ত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুদের বিনিময়ে স্বল্পমেয়াদি তহবিল গ্রহণ করে এবং সংগ্রহ করা তহবিলটিই তারা আবার ঋণ হিসাবে প্রদান করে। এ ধরনের আর্থিক লেনদেন মুদ্রা বাজারের মূল অংশ হিসেবে বিবেচিত। একটি দেশের ব্যাংকব্যবস্থা হলো মুদ্রা বাজারের অন্যতম অংশ বা চালিকাশক্তি। এ রকমের লেনদেনের ব্যবস্থাটা যদিও স্বল্পমেয়াদি মুদ্রা বাজারের অন্তর্ভুক্ত তবে এর প্রভাব সামাজিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংকব্যবস্থাটা তেমন একটা ভালো অবস্থানে নেই। দেশের বেশকিছু ব্যাংক তাদের পরিচালনার ত্রম্নটি, আয় ব্যয়ের ব্যবস্থায় অনিয়ম এবং ঋণখেলাপিসহ অন্যান্য অনিয়মের কারণে খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। এমন অবস্থায় সরকার যদি উপরোলিস্নখিত আইনটি প্রচলন করেন তাহলে দেশের বেশির ভাগ নিবন্ধনকৃত ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারী হারাবে বলে আশঙ্কা করা যায়। যদিও কোনো কারণে আমানতকারী না হারালেও আমানতকারী কর্তৃক ব্যাংকগুলো যে মূলধনটা সংগ্রহ করতে পারত তা হয়তো আর পারবে না। এর ফলে দেশের আইনিভাবে নিবন্ধনহীন আর্থিক সংস্থাগুলো লাভবান হবেন। কারণ আমানতকারীদের এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক নিরাপত্তা এবং লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দিকে টানবে। ফলে সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাটা একটি অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হবে। দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থবাজার হলো পুঁজিবাজার। বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজার স্থবির হয়ে পড়েছে। এই স্থবিরতার মূল কারণ হলো বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম। দেশের পুঁজিবাজার থেকে কিছু নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান শেয়ার বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বটাও সরেজমিনে নাই। ইউনাইটেড এয়ার ওয়েজ নামক একটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে দেশে ইউনাইটেড এয়ার ওয়েজের কোনো বিমান সচল নেই। এই প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীরাও বিমান নেই বা প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। ফলে এই শেয়ার কিনে যারা উলিস্নখিত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন তাদের মাথায় হাত। ইউনাইটেড এয়ার ওয়েজের ফেইস ভ্যালু ১০ টাকা কিন্তু বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে মাত্র এক টাকা পঞ্চাশ পয়সায়। যে কোনো দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসাবে পুঁজিবাজার সে দেশের অর্থনীতিতে একটি উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাজারের মূল লক্ষ্য হলো, বিনিয়োগকারীর স্বার্থসংরক্ষণ, সিকিউরিটি মাকের্টের উন্নয়ন এবং এসংক্রান্ত বিষয়াবলি বা আনুষাঙ্গিক বিধানগুলো প্রণয়ন। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কি এই বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখছেন। যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন প্রতিষ্ঠানের ফেইস ভ্যালুর চেয়ে তার শেয়ারের বাজার মূল্য কি করে কমে গেল? এই প্রশ্নের উত্তরটা কি দেবে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন বাজার থেকে অর্থ নেয়ার নিমিত্তে শেয়ার ছাড়ে তখন তার মোট সম্পদ এবং সম্পত্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানটি হলো সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন কি ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ারের মূল্য এরকম কমে যাওয়ার বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। শেয়ারের মূল্য ফেইস ভ্যালুর চেয়ে কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক তবে এই স্বাভাবিকত্বেরও ব্যাখ্যা আছে। সুতরাং এই ব্যাখ্যাগুলো বিনিয়োগকারীদেরও জানা প্রয়োজন। দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ লাখের বেশি। পুঁজিবাজারে ত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারীই বর্তমানে লোকসান গুনছেন। পুঁজি হারিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছেন। দেশের মুদ্রাবাজারে সঞ্চয়ের হার কমে যাওয়ার কারণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ বাড়ার কথা; কিন্তু সেই রকম ঘটনা ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই বর্তমান পুঁজিবাজার ব্যবস্থায়। কারণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীই চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন তাই মুদ্রা বাজারে যারা বিনিয়োগ করতেন তারা পুঁজিবাজারে আসবেন না। মুদ্রাবাজারে সঞ্চয় প্রকল্পগুলোর সুদের হার কমে যাওয়ায় দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিপাকে পড়বেন। কারণ পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, এফডিআরসহ এ ধরনের সঞ্চয় প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করেন বা এ ধরনের সঞ্চয়পত্র বা বন্ড কেনেন তাদের অধিকাংশই কায়িক শ্রম বিনিয়োগ করতে পারেন না, যেমন অবসরপ্রাপ্ত ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী, নারীসহ কাজ না পাওয়া বেকার। এদের জীবনযাত্রার ব্যয়ভার আসে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ করা অর্থের সুদ থেকে। সরকার অকস্মাৎ এই সঞ্চয় প্রকল্পগুলোর সুদের হার কমিয়ে দেয়ার ফলে এই পরিবারগুলো আর্থিক নিরাপত্তহীনতায় পড়বে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অবস্থা খুবই নাজুক। পুঁজিবাজারের ধসের কারণে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন যদি মুদ্রাবাজারের অবস্থা সেরকম হয় তাহলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা কোনপর্যায়ে যাবে তা ভাবাই যায় না। তাই আর্থিক স্থবিরতার হাত থেকে সমষ্টিক অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে ব্যাস্টিক আর্থিকবাজার ব্যাংকব্যবস্থায় সঞ্চয়ের সুদের হার কমানো ঠিক হবে না। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক