পাঠক মত

নিরাশ্রয় মানুষ

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শাহজাহান আবদালী ঢাকা
স্রষ্টার পৃথিবীতে মানুষের পদার্পণ সেই কোন ধূসর অতীত থেকে তা আমরা জানি না। তবে, জলাধার, বৃক্ষাদি এবং পাখির অবস্থানের বহু পরে মানুষের পদচিহ্ন পড়ে এই নশ্বর পৃথিবীতে। মানুষের বাসযোগ্য করেই সাজিয়ে রাখা হয় পৃথিবীকে। মানুষ তার বুদ্ধিবলে ধীরে ধীরে বসবাসের উপযোগী গৃহনির্মাণ করে সংসারী হয়ে ওঠে। বস্তুত, পৃথিবী মানুষের এই বিশাল সম্পদের কোনো নির্দিষ্ট মালিকানা ছিল না কারও। কালক্রমে নিজের মতো ভূমি দখল করে বসবাস শুরু করে। এই পৃথিবী খন্ড-বিখন্ড হয়ে নানা মহাদেশ ও দেশে বিভক্ত হয়। পেশিশক্তির মাধ্যমে মানুষের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা দুর্বল তারা সুবিধাবঞ্চিত হয়েছে বাসস্থানের অধিকার থেকেও। আধুনিক বিশ্ব ধনকুবেরা ভাগাভাগি করে নিজেদের অধিকারিত্ব নিয়েছে, অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক মানুষ হয়ে পড়েছে গৃহহারা। এবার এগোচ্ছি আমাদের স্বাধীন ভূখন্ডের দিকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের বাংলাদেশে লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। গত ৪৮ বছরে সেই লোকসংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সীমিত ভূখন্ডের বড় অংশই পেশিশক্তি ও ধনবানদের অধিকারে। বাকি সম্পদ অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে থাকলেও নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য এবং সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে অনেকেই আজ গৃহহারা। অভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং নদীভাঙনের শিকার হয়ে বসত ভিটেটুকু হারিয়ে গৃহহারা মানুষ বাঁচার উদগ্রবাসনায় শহরের ফুটপাত, অলিগলিতে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। ওরা পরিণত হয়েছে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে। এ ভাসমান জনগোষ্ঠীই নিরাশ্রয় অভিধায় আমাদের চোখে হয়ে উঠেছে সমাজের অপাঙ্‌ক্তেয় অংশ। এই ভাসমান নিরাশ্রয় জনগোষ্ঠী সঙ্গত কারণে সমাজের ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে ওঠে। অভাবের তাড়নায়, বাঁচার তাগিদে নিরন্ন শিশুরা অর্থাৎ যাদের আমরা টোকাই বলে থাকি, ওরা মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য- এর কোনোটিও ভোগ করতে পারছে না। কারও কারও মা-বাবা নেই। কারও মা-বাবা থাকলেও বাবা বিয়ে করেছে অন্য মহিলাকে, অন্যদিকে মা অন্য পুরুষকে বিয়ে করে দিনাতিপাত করছে। নিরুপায় হয়ে এসব শিশু খালি পায়ে, উদোম গায়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে পানির খালি বোতল, ভাঙা জিনিসপত্তর ও ডাস্টবিনে ঘাঁটাঘাঁটি করে এটাসেটা ব্যাগে ভরে বিক্রি করে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। রাতের বেলা ওরা খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। তারা মা-বাবার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত। নেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অনুপ্রেরণাকারী। তাদের নেই ঈদে জামা-কাপড় পরার আনন্দ। সঙ্গত কারণে পেয়ে যায় সমমনা বন্ধু-বান্ধব। দলবেঁধে গড়ে তোলে নিজস্ব জগৎ। খায় বিড়ি-সিগারেট, ধরে গাঁজা ফেনসিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য। নেশার টাকার অভাব দেখা দিলে জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই ও খুনোখুনিতে। রাজনৈতিক নেতাদের টাকার বিনিময়ে ওরা ভাড়াটে খুনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কেউ কেউ মারামারি ও খুনোখুনি করতে গিয়ে মার খেয়ে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করে। কেউ কেউ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বেধড়ক মার খায়, কেউ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে পড়ে থাকে। ব্যতিক্রম হিসেবে কেউ কেউ টপটেরর হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করে। এসব মানুষ নিয়ে আমাদের ভয়াবহ সমস্যা। বর্তমান সরকার বিগত দিনে গণমানুষের মঙ্গলার্থে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে একটি হলো, একটি ঘর একটি উঠোন এবং আশ্রয়ন প্রকল্প। এখানে নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়ের একটা স্থান হলেও বিশাল সংখ্যক মানুষ আজও সেই সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ও সচেতন মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে এলে অনেক সুফল বয়ে আসে। এ ছাড়া রাজধানীর শহরতলিতে শতশত একর খাসজমি রয়েছে। সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থাসহ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে অতি শিগগির এর একটা সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি। সেই ভাবনা থেকে 'নিরাশ্রয় মানুষ', সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থকে পুঁজি করে এগিয়ে চলার পথ আরও প্রশস্ত হবে সর্বস্তরের মানবিক মানুষের সমর্থন এবং শুভবোধে। সেই শুভবোধ জাগ্রত হোক সবার মধ্যে। অবশ্যই এভাবে আমরা একদিন নিরাশ্রয়মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। জয় হোক শুভবাদের, জয় হোক মানবতার।